
পাল তোলা নৌকা
প্রকৃতরি কবি জীবনানন্দ দাস বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘শরৎ যেন ভেসে উঠে অপরূপ রুপে। আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনো শারদ প্রভাতে ! হে মাত বজ্র শ্যামল অঙ্গ ঝলিচে অমল সুভাতে। বাঙ্গালী জাতি হিসাবে আমাদের রয়েছে নদী কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিক যানবাহনের বহুল প্রচলনের আগে আমাদের যোগায়োগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী আর নৌকা। যুগের হাওয়া লেগেছিল পালে, দ্রত থেকে দ্রততর ছুটতে হবে আমাদের।
তাই দ্রত ছুটে যাচ্ছি আমরা মৃত্যুর দিকে, ধারণ করে চলছি যান্ত্রিক সভ্যতা। তাই পাল তোলা নৌকাতে এখন আর আমাদের চলে না। ইঞ্জিন চালিত নৌকা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কালো ধোঁয়ার পরিবেশ মরে যাচ্ছে এতে আমাদের সন্তানেরা পাবে বিষাক্ত পরিবেশ। বেড়ে উঠবে এজমা নিয়ে- দুরারোগ্য অসুখের শ্বাস কষ্টের বিনিত বাতাসে। বর্তমানে কালেভদ্রে দেখা মিলে পাল তোলা নৌকার।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাস বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন, শরৎ যেন ভেসে উঠে অপরূপ রুপে। আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনো শারদ প্রভাতে ! হে মাত বজ্র শ্যামল অঙ্গ ঝলিচে অমল সুভাতে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দয্য বর্ণনা করা বা এর চিত্র তুলে ধরা একটি কঠিন বিষয় কেননা আমাদের ৬৫ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটিকে সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে সাজিয়েছেন। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীতে বাংলার প্রকৃতির বন্ধনা করেছেন। সৌন্দেয্যের আধাঁর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বছরের একেক সময় একেক রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়ে থাকে। তেমনি আমাদের মাঝে হাজির হয় নবরূপে শরৎ কাল।
শুভ্র মেঘের দিগন্ত বিস্মিত আকাশে সাদা ও নীলের বেলা বিমুহিত করে আমাদেরকে। প্রকৃতির অভিনবত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে শরৎকে কাছে পাবার তারনা সবার মাঝে বিরাজ করে, কেননা শরৎ আর কাশফুল একই নদীর দুটি ধারা। শরৎতের দিগন্ত জোড়া মাঠে সাদা কাঁশফুলের মাঝে হারিয়ে যেতে মনে প্রেম জাগ্রত হয় শিশুদেরও । মাঝি মাল্লাদের মনে লাল সবুজের পালতোলা নৌকা সহ মাঝ নদীতে আনন্দ জাগায় শরতে।
বর্ষা-শরতের অপার শোভায় বিমোহিত হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলী, শরৎ তোমার শিশির ধোয়ার কুন্ডলে বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলে .....’।
কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, গানে, উপন্যাসে বাংলার প্রকৃতির সবকিছুই ফুটে উঠে। কবি গুরু তার ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যে বর্ননা দিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির সেই রূপ চিরন্তন হয়ে আছে। বর্ষা-শরৎ প্রকৃতি মানব হৃদয়ে রোমানন্টিকতার যে সুর তুলে ধরে’ তা অন্যকোন ঋতুতে মিলে না। বিশ্ব জুড়ে জলবায়ুর যতই পরিবর্তন হোক বাংলার স্বরঋতুর হেরফের হতে পারে।
কিন্তু বৈচিত্রে পরিবর্তন আসতে এখনো অনেক দেরী। এই সময়টা ব্রক্ষপুত্র নদের পাড়ে চোখ পড়ে নদের দিকে উত্তাল ডেউ নেই, নদীতে জলরাশির স্তব্দতা আকাশ একটু মেঘলা হলেই ঢেউ নেচে উঠে। নদীর তীর ও কোথাও সামান্য সবুজ কোথাও নদীর কিনার ঘেষে কাশ ফুল ঘেষে যখন নৌকা বয়ে যায় তখন মাঝিদের সাথে যাত্রীরা অনুভব করে অনাবিল সুখ।
এই সময়ে প্রকৃতির বাতাস এসে দোল খায় পাল তোলা নৌকায়। একটা সময় নদীর কিনারা দিয়ে গুনটানা (দড়ি) নৌকা চলতো এখন আর তা চোখে পড়ে না। বাতাসের অনুকুলে যাওয়ার জন্য বড় কাপড় দিয়ে আটকানো হতো পাল তোলা নৌকা। আজকাল তাও কমে গেছে নৌকার পালকে কোন কোন এলাকায় বলা হয়ে থাকে বাদাম। যার নৌকা যত বড় বাদাম থাকতো সেই নৌকা বাতাসের গতির সঙ্গে জুড়ে চলতো। নদী আর নৌকা ছিল আমাদের গ্রাম জীবনের বহমানতা।
নদী, হ্রদ কিংবা সমুদ্র তীরবর্তী এক জনপথের সঙ্গে আরেক জনপদের যোগাযোগের সাহায্য করে আসছে নৌকা, বহুবছর আগে থেকেই বাংলাদেশের নদ-নদী খাল-বিল অজস্্র এমন অনেক এলাকা রয়েছে আজো, যেখানে মানুষের জীবন নৌকা ছাড়া অচিন্তনীয় কিন্তু এ বাহনটির ইতিহাস কি তাও কেউ জানে না। তবে নৌকার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ বেদে ।
মনসা মঙ্গল ও বাংলার সামাজিক সাস্কৃতিক ইতিহাস কাব্যে বনিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী ১৪ডিঙ্গা নির্মাণ করে বাণিজ্য যাত্রা করে ছিলেন। ক্রিট দ্বীপের মানুষেরা ১ লাখ ৩০ হাজার বছর আগে নৌকার ব্যবহার জানতো বলে জানাযায়।
ব্রহ্মপুত্র নদের কাশফুল দেখতে ঘুরতে আসা গফরগাঁও বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল কাইয়ুম, ইলিয়াছ, শফিকুল, জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, একটা সময় এই ব্রহ্মপুত্র নদীতে জাহাজ ও হাজার মনি নৌকা চলাচল করত। পলি পরে নদী ভরাট হওয়ার কারণে এখন আর সেই দিন নেই। তবুও একটু প্রশান্তির জন্য ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এক খণ্ড জমিতে কাশফুলের সৌর্ন্দয্য ও মাঝে মধ্যে পাল তোলা নৌকা দেখে মন জুড়িয়ে যায় তাই এখানে এসেছি।
বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকার নাম হচ্ছে ডিঙ্গি। নদীর তীরে যারা বসবাস করেন তারা সকলেই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন নদী পারাপার বা অন্যান্য কাজে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবিস্কৃত সবচেয়ে পুরানো ৭ থেকে ১০ হাজার বছর আগে। কুয়েতের ফাইলাকা দ্বীপে পাওয়া যায় সমুদ্রগামী জাহাজ বা ‘রিড বোড’ তৈরি হয়েছিল ৭ হাজার বছর আগে। মহাসাগরে খ্যি খ্রীষ্ট পর্ব ৪ হাজার থেকে ৩ হাজার সালে প্রচুর জলযানের আনাগোনা ছিল বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছে। সিন্দু সভ্যতার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রকমের নৌকার অস্থিত্বের কথা জানা যায়।
এখন থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে ভূমধ্য সাগরে বহু দাঁড় বিশিষ্ট নৌকা দেখা যেত। নৌকায় দাঁড় টানার কাজে ব্যবহার করা হত কৃতদাসদের। দাঁড় টেনে নৌকা বাওয়া অত্যান্ত শ্রমসাধ্য ও ক্লান্তিকর। পালের উদ্ধাবন এ অবস্থা থেকে মানুষকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। দাঁড় টানার সঙ্গে পাল টানানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যায় এবং হাওয়ার গতিতে নৌকা আরও বেশি বেগমান হয়। তখন থেকেই নানা ধরনের পালের ব্যবহার শুরু হয় বাতাসের শক্তি কাজে লাগানোর জন্য ।
বাংলার বারভূইয়াদের একটা বিরাট বহর ছিল ঈশা খাঁ ১৫৭৫ খ্রিষ্টাদ্বে বাংলা থেকে নওয়াবদের বিতারিত করেন রনতরীর সাহায্যে। বিক্রম পুরের কাছে নৌ যুদ্ধে মান সিংহের নৌ বহরের উপর তার চূড়ান্ত বিজয় ষোড়স শতকে বাংলার নৌ শক্তির একটি উজ্জল প্রমাণ।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পাল তোলা নৌকার প্রচলন প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে। নদীতে মাঝে মধ্যে পালের নৌকা দেখা মেলে । পাল তোলা নৌকা চলাচলের দৃশ্য এখন বিরল, এটি এখন কেবলই স্মৃতি।
এসআর