ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

তেলিখালীর যুদ্ধে দুই শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়

মজিবুর রহমান ফয়সাল, নান্দাইল

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

তেলিখালীর যুদ্ধে দুই শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়

সুজয় কুমার দেব 

দিনটি ছিল ৩ নভেম্বর। একাত্তরের এই দিনে ভারতীয় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাটের তেলিখালী ক্যাম্প পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করতে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা মিলে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দুইশ’র বেশি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে খতম করি। এই যুদ্ধে সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩০ জন শহীদ হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন ময়মনসিংহের নান্দাইলের উত্তরমুশুলী গ্রামের বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অব.) বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজয় কুমার দেব।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজয় কুমার বলেন, বাবা শহীদ সতীশ চন্দ্র দেব ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ‘৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মুশুলী হাইস্কুলের নিজের প্রাক্তন ছাত্রদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ঐক্যবদ্ধ করেন। এর পর বাবা স্কুলের মাঠে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে সেখানে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সে সময় বাবার কাছে অর্ধশতাধিক ছাত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। আমি যুদ্ধের প্রথম ও প্রাথমিক প্রশিক্ষণ বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।

প্রশিক্ষণ শেষে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ভাষা সৈনিক রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার সহযোগিতায় আমিসহ ২৬ জন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলায় একটি ক্যাম্পে এক মাস প্রশিক্ষণ নিই। প্রশিক্ষণের পর আমাদের শপথ পড়ানো হয়। প্রথমদিকে সীমান্তের কাছে ছোট ছোট যুদ্ধে পাঠানো হয়। অক্টোবর মাসে ১১নং সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণে সুজয় দেব আরও বলেন, যুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা আজো মনে শিহরণ জাগায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল তেলিখালি এলাকার যুদ্ধ। সে সময় স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় হালুয়াঘাট সীমান্তের তেলিখালি ক্যাম্প দখল করে নিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। এই ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনারা বিশাল অস্ত্র ও গোলাবারুদের ভা-ার গড়ে তোলে। আর আশপাশের ক্যাম্পগুলোও দখলে নিয়ে নেয় তারা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি পুরো ইউনিট ছিল এই তেলিখালি ক্যাম্পে।

মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা করে তেলিখালি ক্যাম্প পাকিস্তানি সেনাদের দখল থেকে মুক্ত করবে। এ জন্য যৌথ বাহিনীর সদস্যদের কয়েকটি কোম্পানিতে ভাগ করা হয়। আমার কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সামছুদ্দিন আহম্মেদ। তার নেতৃত্বে কোম্পানির শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। আমরা কমান্ডারের সিগন্যাল পাওয়ার পর পুকুর ও জঙ্গল মাড়িয়ে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালাই। এর জবাবে পাকিস্তানি সেনারাও ক্যাম্পের বাংকার থেকে পাল্টা গুলি চালায়। পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময়ের এই সম্মুখযুদ্ধে আমাদের সাত বীর মুক্তিযাদ্ধাসহ অন্তত ৩০ জন শহীদ হন। অপরদিকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের ২০০-এর বেশি নিহত হয়। সেই সময় যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস করা হয়। তার মধ্যে কিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে আসে। আর জীবিত পাক সেনারা পিছু হটে ময়মনসিংহ শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিছুদিন পর পুরো শহরে কারফিউ ঘোষণা করে পাকসেনারা ঢাকায় পালিয়ে যায়।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, আমার বাবা সতীশ চন্দ্র দেব এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছিলেন। হানাদারদের পথ আটকাতে তিনি কালীগঞ্জ রেল সেতু ও তারেরঘাট সড়ক সেতু ভাঙায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এসব কারণে রাজাকার-আলবদররা বাবার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। ৫ ডিসেম্বর রাতে উত্তর মুশুলী গ্রামের বাড়ি থেকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক হানাদাররা বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পর চ-ীপাশা ইউনিয়নের বারইগ্রামের বধ্যভূমির পাশে ইটভাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বাবার মরদেহ উদ্ধার করে। যুদ্ধ শেষে ঢাকায় আসার পর বাবার মৃত্যুর খবর পাই।

×