ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

৭০ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি!

এস,এম জসিম উদ্দিন, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

৭০ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি!

অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলাম

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলাম ছিলেন ৫২’র ভাষা আন্দোলনের এক সাহসী  সৈনিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বে যে ক’জন সাহসী সূর্যসন্তান তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন দবিরুল ইসলাম তাদের একজন। তারপর পেরিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর। কিন্তু এত বছর পরেও ভাষা সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি দবিরুল ইসলাম। তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন মরহুম দবিরুল ইসলামের পরিবার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বেশ কয়েকবার মরহুম অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ দবিরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখে গেছেন। যাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সেদিন বেগবান হয়েছিল দবিরুল ইসলাম ছিলেন তাদের একজন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র, এমএলএ, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (যুক্তফ্রন্ট)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের নায্য আন্দোলনে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
৫২’র ভাষা আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দবিরুল ইসলামকে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে দিনাজপুর জেলা কারাগারে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। কিন্তু কারাগারে নির্মম নির্যাতনের কারণে তার স্বাস্থ্য চরমভাবে ভেঙে পড়ে। ফলে তিনি হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। একসঙ্গে রাজনীতিও করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করার সময় ছাত্র রাজনীতি করার জন্য বহিষ্কৃত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দবিরুল ইসলাম সম্পর্কে ৮৮, ১১০, ১১৩-১৪ ও ১২৬ পৃষ্ঠায় অনেক কিছুই লিখে গেছেন।
মরহুম অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলামের স্ত্রী আবেদা খাতুন (হেনা) বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার স্বামীর অসম্ভব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তা নিজেই দেখেছি। বিয়ের ১০ বছরের মাথায় স্বামী হারিয়ে কোলের শিশুদের নিয়ে কী যে করুণ দিন পার করেছি! এতো আন্দোলন সংগ্রাম করেও দবিরুল ইসলাম এখনো ভাষাসৈনিক হিসেবে কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলো না। মরার আগে যদি তার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারতাম তাহলে মরেও শান্তি পেতাম।’
ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া গ্রামে ঘুমিয়ে আছেন ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলাম। এখন তিনি শুধুই ইতিহাস। জাতি ভুলতে বসেছে তার অবদানের কথা। নতুন প্রজন্মের অনেকে তার সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই জানে না। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঠাকুরগাঁও শহরের কালীবাড়ি সাধারণ পাঠাগার চত্বরে তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটি কিছুদিন আগে সংস্কার করলেও এখন অনেকটা অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে আছে। তার স্মৃতিসৌধের আশপাশে জমে আছে ময়লার স্তূপ।

ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বাবলু বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ঠাকুরগাঁওয়ে এসে নিজেই দবিরুল ইসলামের কথা বলেছেন। ওই দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘উনি আমার বন্ধু মানুষ, উনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমার মতোই বড় নেতা হতেন। আমি ঘুরে দেখলাম কোথাও তার কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই। আমি নির্দেশ দিলাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দবিরুল ইসলামের স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে চাই। তার নির্দেশেই তখন সাধারণ পাঠাগার মাঠে দবিরুল ইসলামের ছোট একটি স্মৃতিস্থম্ভ করা হয়। সম্প্রতি যেটাকে সংস্কার করা হয়েছে।’
দবিরুল ইসলামের ছোট ছেলে আহসান উল্লাহ (ফিলিপ) আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধু কতটা ভালোবাসতেন তা তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, সহপাঠী হয়েও আজ পর্যন্ত ভাষাসৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না। তাই সরকারের কাছে আমার মা ও আমাদের পরিবারের সকলের দাবি আমরা যেন আমার বাবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারি।

×