ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

মুক্তিযোদ্ধারা শহর ঘিরে ফেললে পাকসেনারা পালিয়ে যায়

মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মুক্তিযোদ্ধারা শহর ঘিরে ফেললে পাকসেনারা পালিয়ে যায়

মো. নূরুল হক ভূঁইয়া

মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ ও শত্রুঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করতে আত্মঘাতী আক্রমণসহ পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কিশোরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদেরই একজন মো. নূরুল হক ভূঁইয়া। তিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দানাপাটুলি ইউনিয়নের গাগলাইলে জন্মগ্রহণ করেন।

মরহুম আব্দুল হাসিম ভূঁইয়া ও মোছা. ফুলবানু দম্পতির আট ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি স্বাধীন ভূখ- ও লাল-সবুজের পতাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ছুটে যান। পরে তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫ নম্বর সেক্টরে অসীম সাহসের সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেন। 
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে নূরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ১৯৭১ সালে ১০ম শ্রেণিতে পড়াকালীন করিমগঞ্জের নানশ্রী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গণি স্যারের উৎসাহে তিনিসহ এলাকার ১৩ ছাত্র-যুবক সংগঠিত হয়ে ট্রেনিংয়ে যেতে উদ্যোগী হন। এ সময় তারই পরামর্শে গাগলাইল গ্রামের তিনিসহ তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য তমিজ উদ্দিন, দুলাল মিয়া, সুন্দর আলী, চাঁদের হাসি গ্রামের আনোয়ারুল হক, আব্দুল লতিফ, আ. জব্বার, আ. খালেক ও বাঁশহাটি গ্রামের সফিউদ্দিনসহ অন্যরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে ছুটে যান। 
তারা সবাই দক্ষিণ নানশ্রী থেকে নৌ-পথে বালাট ক্যাম্পের উদ্দেশে রওয়ানা করেন। নৌকাযোগে বিশ্বম্ভপুর থানা এলাকা পৌঁছে তারা পাঁয়ে হেঁটে বালাট ক্যাম্পে যান। সেখানের ক্যাম্পে অবস্থানকালে কলেরা-আমাশয় মহামারি রূপে দেখা দিলে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ট্রেনিং না করেই মাথিয়া গ্রামের আবুল কালাম, গিয়াসউদ্দিন, আ. জব্বার ও আবু তাহের দেশে ফিরে আসেন। তবে নূরুল হক ভূঁইয়া দেশমাতৃকার টানে ওই ক্যাম্পে থেকে যান। 
পরে ভারতের বালাট ক্যাম্পের পরিচালক মো. আবদুল হামিদ সাহেব (বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি) রিক্রুটিং করে তাকে লাভাইয়ুথ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ৪-৫ দিন থাকার পর তাকে মেঘালয় রাজ্যের ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে ২৮ দিন পর গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সাব সেক্টর কমান্ডার মুসলেহ উদ্দিন ওরফে দ্বীন তার অধীনে টেকেরঘাট মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

পরবর্তীতে তারই নেতৃত্বে নূরুল হক ভূঁইয়া তাহেরপুর, দিরাই, লক্ষ্মীপুর এলাকায় একাধিকবার আক্রমণ করাসহ গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও এ সময় তিনি বিভিন্ন খ- খ- যুদ্ধে অংশ নেন। তাদের আক্রমণের মুখে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এ সময় স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক ভূঁইয়া বলেন, তাহেরপুর থানা মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালায়। কিন্তু তা মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর গেরিলা যুদ্ধে আমরা তাহেরপুর থানা মুক্ত করি। এ সময় স্থানীয় দুজন রাজাকার তাদের হাতে ধরা পড়ে।
তিনি বলেন, তাহেরপুর মুক্ত করার পরপরই তাকে মেজর মোতালিবের অধীনে সুনামগঞ্জ মুক্ত করার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বালিগাঁও ক্যাম্পে অবস্থানকালে তারই নেতৃত্বে নূরুল হক ভূঁইয়াসহ অন্যরা সুনামগঞ্জ মুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নেন। সবারই উদ্দেশ্য ছিল ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে সুনামগঞ্জ মুক্ত করা হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা পুরো সুনামগঞ্জ শহরকে ঘিরে রাখেন। পাকসেনারা টের পেয়ে ৫ ডিসেম্বর রাতে সুনামগঞ্জ শহর ছেড়ে সিলেটে পালিয়ে যায়। এর আগে পাকসেনারা দুই মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে লাশ সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

অন্যদিকে ৬ ডিসেম্বর সকালে বিনা রক্তপাতে মেজর মোতালেবের নেতৃত্বে সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে আরও ১০ দিন সুনামগঞ্জ শহরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করে শান্তি শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত থাকেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর রাতে নূরুল হক ভূঁইয়াসহ এলাকার অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা সাচনা হয়ে লঞ্চযোগে নিকলী নেমে নিজগ্রামে ফিরে আসেন।
তবে ১৬ ডিসেম্বর দেশবাসী মুক্তির স্বাদ অনুভব করলেও কিশোরগঞ্জবাসী সেদিন বিজয় দেখেনি। পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করেছিল একাত্তরের ১৯ এপ্রিল, আর শহর ছেড়ে চলে যায় ৪ ডিসেম্বর। পাকবাহিনী চলে গেলেও শহরের জামিয়া বিল্ডিংকে প্রধান ঘাঁটি করে কয়েকশ’ সশস্ত্র স্বাধীনতাবিরোধী শহরকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।

তবে মুক্তিবাহিনীও শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখে। কিন্তু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি এড়াতে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন শত্রুর ওপর আক্রমণ চালায়নি। অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে ১৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে রাজাকার, আলবদরসহ সকল স্বাধীনতাবিরোধীরা মাইকে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা দেয়ার ঘোষণা দেয়। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার সবুজ জমিনে লাল সূর্য খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা কিশোরগঞ্জ শহরের ঘরে ঘরে উত্তোলিত হয়।

×