ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যেক গ্রামে ডিজিটাল সেবা ॥ কুঁড়েঘর চোখে পড়ে না

গ্রামে এখন শহরের আমেজ

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

গ্রামে এখন শহরের আমেজ

কুঁড়েঘরের বদলে গ্রামে গ্রামে চোখে পড়ে আলীশান বহুতল বাড়ি

দেশের প্রতিটি গ্রামে এখন শহরের আমেজ। দরিদ্র্রপীড়িত জেলা লালমনিরহাটে এখন আর খড়ের ঘর চোখে পড়ে না। পাল্টে গেছে গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র। শহরের মতো গ্রামেও এখন বহুতল ঘর বাড়ি। আধা পাকা বাড়ি ঘর চোখে পড়বে। খড়ের ঘর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্রাম এখন শহরে পরিণত হয়েছে। শহরের মতো পাকা রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক এখন সব গ্রামে চলে এসেছে। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র ও ভূমি অফিস হতে ডিজিটাল সেবা ঘরে বসে পাচ্ছে মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের গ্রাম হবে শহর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে। এখন পুরো বাংলাদেশ একটি শহুরে গ্রাম। গ্রাম এখন শহর। শহরের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রামের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। 
জানা গেছে, এক সময় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ছিল সমাজের রঁন্ধে রঁন্ধে। তথ্য প্রমাণের অভাবে প্রতিবাদ পর্যন্ত করার উপায় ছিল না। এখন দিন পাল্টে গেছে। ভূমি অফিস, ইউনিয়ন পরিষদের সেবা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ঘরে বসে পাচ্ছে গ্রামের মানুষ। সরকারের সকল সেবার খবর ওয়েবসাইটে রয়েছে। সাধারণ মানুষ জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, ভিজিডি কার্ড, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, টিসিবির কার্ড, জমির পর্চা, খাজনা, খারিজ, খতিয়ান, জাবেদা, নাগরিকত্ব, চারিত্রিক সনদ সব সেবা শহরের মতো ঘরে বসে পাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম কখনো বুঝতে পারবে না প্রকৃত গ্রামীণ পরিবেশ কেমন ছিল। গেঁও শব্দটির যথার্থতা এখন গ্রামে নেই।
বর্তমান সরকারের আমলে গ্রামের মানুষের স্থায়ী অর্থনৈতিক সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়েছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পারিবারিক চাহিদা মোকাবিলায় তাই প্রমাণ করেছে। গ্রাম ও শহরের অর্থনৈতিক পার্থক্যের দূরত্ব কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। বরং এখন উল্টো চিত্র। মধ্যবিত্ত এখন কষ্টে আছে, ‘না ঘর কা না ঘাট কা’। শ্রমজীবী দিনমজুর শ্রেণি এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে কোনো না কোনো কাজ করছেন। মাসিক তাদের আয় ৫০-৬০ হাজার টাকা।

একজন বেসরকারি কলেজ শিক্ষকের মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। কলেজ শিক্ষক হতে তাকে কমপক্ষে এমএ পাস করতে হয়েছে। শ্রমিক সে এসএসসি পাস করে কোনো গামের্ন্টস ফ্যাক্টরিতে কয়েকমাস কাজ করার পর তার যোগ্যতায় সে ২৫ হাজার টাকা বেতন ভাতা পাচ্ছে। এখন গ্রামে দিন হাজিরায় কাজের লোক পাওয়া যায় না। চুক্তিতে শ্রমিক নিতে হয়। এভাবে এখন শহরের মতো গ্রামেও কর্মক্ষেত্র বেড়েছে। 
কয়েকবছর আগেও শীত মৌসুমে নতুন ধানের নাড়ায় (খড়ের আঁটি) গ্রামে ঘরের ছাউনি ও নতুন খড়ের ঘর নির্মাণের ধুম পড়ে যেত। এখন গ্রামে কোথাও খড়ের ঘর চোখে পড়ে না। খড়ের ঘর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খড়ের ঘর এখন গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হিসেবে শহরে স্থান করে নিয়েছে বিত্তশালী পরিবার ডেকোরেশনে কাজে। খড়ের ঘর ব্যবহার করছে পাকা ঘরের ডেকোরেশনে। কয়েকবছর আগেও স্বল্পমূল্যে বাঁশ খড় দিয়ে ছাউনি ও বেড়া নির্মাণ করে নতুন ঘর তৈরি করা হত। এই সব ঘরের নাম ছিল কুঁঁড়ে ঘর। নি¤œœ শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ খড়ের ঘরে বসবাস করত। 
মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণির পরিবার খড়ের ঘর বাড়ির বাইরে উঠানে বৈঠকখানা বা কাছারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যেত। নি¤œ ও উচ্চবিত্তের কুঁড়ে ঘর নির্মাণে ছিল নির্মাণশৈলীতে বিস্তর পার্থক্য। স্বল্প আয়ের মানুষেরা খড়ের চালা ও খড়ের বেড়া ব্যবহার করত সাদামাটাভাবে। বিত্তবান পরিবারগুলো খড়ের ঘরের ছাদ দিত কিন্তু বেড়া দিত বাঁশের বা কাঠের। এসব বাঁশের বেড়ায় থাকত নানা শৈল্পিক বাঁশ-মাঠের হাতের কারুকাজ। বিশেষ করে গ্রামে বিত্তশালী প্রতিটি পরিবারে থাকত নাকাড়ি ঘর।

এটা মূলত বাহিরে লোকজনের বৈঠকখানা বা বিশ্রামের প্রয়োজন ব্যবহার হতো। এখন আর সেই প্রচলন নেই। খড়ের ঘরের জায়গায় টিনের ছাদ ও টিনের বেড়ার ঘরের প্রচলন হয়ে গেছে। এখন গ্রামের ইটের ঘরের প্রচলন হয়ে গেছে। প্রতিটি গ্রামে এখন ইটের ভাটা দেখা যায়। কোনো কোনো গ্রামে তো এখন বহুতল ভবন চোখে পড়ে। পাঁকা ইটের বাড়ির স্বাভাবিক ঘটনা। 
৯০’র দশকে গ্রামে সাধারণত কুঁড়ে ঘর ছিল সব গ্রামে। ইটের কিংবা টিনের ঘর ছিল শহরে। এর প্রধান কারণ গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র ছিল কৃষিখাত ও কৃষি নির্ভর। গ্রামে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের বসবাস ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নাজুক। পরিবহন ব্যবস্থা ছিল অযান্ত্রিক। গ্রাম হতে শহরকে খুব দূরে মনে হত। এখন চিত্র পাল্টে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল-পরিবর্তন হয়েছে। তৈরি হয়েছে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যান্ত্রিককরণ হয়েছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। টিন, ইট, সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য হয়েছে। কালে আবর্তে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র এখন গ্রামে। 
২০০৮ সালের পর সরকারে দূরদর্শিতা, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে সরকার নানা উদ্যোগ নেয়। ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। যার প্রধান সূচক গ্রাম হতে কুঁড়েঘর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন চোখে পড়ে না কুঁড়েঘর। এখন টিনের ছাদ ও টিনের বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ চোখে পড়ে। খড়ের চেয়ে টিনের ঘর নির্মাণ ব্যয় কম। বরং খড়ের ঘর নির্মাণ খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। খড়ের ঘর টেকসই কম হয়। টিনের ঘরের টেকসই বেশি হয়।

টিনের ঘরের চেয়ে খড়ের ঘর অনেক আরাম দায়ক ও পরিবেশবান্ধব হয়। খড়ের ঘরকে প্রাকৃতিক এসি রুমের ঘর বলা হয়ে থাকে। খড়ের ঘর গরমের দিন ঠা-া ও ঠা-ার দিন গরম থাকে। সাধারণত বাহিরে আবহাওয়া হতে ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার হেরফের হয়ে থাকে। খড়ের ঘর স্বাস্থ্যসম্মত। খড়ের ঘরের নানা রকম নাম রয়েছে চালা, দো চালা, চৌয়ারী, দক্ষিণ দুয়ারী, বাংলা ঘর প্রভৃতি। এখন এসব ঘরের নাম ও খড়ের ঘর শুধু স্মৃতি। এখন কোনো গ্রামে আর খড়ের ঘর চোখে পড়ে না।

কোনো কোনো গ্রামে কালেভদ্রে খড়ের ঘর দেখা যায় দুই- একটা। সেটাও কোনো সৌখিন বিত্তশালীর বাড়িতে। ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে রেখেছে। যারা এই খড়ের ঘর তৈরি করতে পারদর্শী তাদেরকে বলা হয় ছাপরবান।
গ্রাম শহর হয়ে যাওয়ায় সহজলভ্য খড়ের দাম এখন ধানের চেয়ে দামী পণ্য। এক মণ শুকনো ধান কুড়ি টাকা কেজিতে পাওয়া যায়। এক মণ শুকনো খড়ের দাম ২৪০০ টাকা। খড় এখন শুধু গো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয় তা কিন্তু নয়। এখন খড় পারটেক্স শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। ব্যবহার হয় হস্ত শিল্পের আসবাবপত্র তৈরির শিল্প হিসেবে।
এদিকে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল গ্রাম হবে শহর। সেই গ্রাম শহরে পরিণত হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে।

বেড়েছে বাসস্থানের ও খাদ্যের জন্য ব্যয়ের সক্ষমতা। এই গ্রামকে শহরে রূপান্তর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রাম হতে বিতাড়িত হয়ে গেছে কুঁড়ে ঘর। সেই জায়গায় এখন টিন ও ইটের ঘর চোখে পড়ে। গ্রামে যেমন খড়ের ঘর এখন নেই। তেমনি প্রতিটি গ্রামে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক পৌঁছে গেছে। পাকা এলজিইডির রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামে সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। শতভাগ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। এখন শহরের আমেজ গ্রামে।

গ্রামের হাট বাজারে পাওয়া যায় অত্যাধুনিক সব ধরনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। সকল প্রকার ব্যবহারিক ইলেক্ট্রনিক পণ্য টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, মাইক্রোওভেন, গ্যাস সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা, নানা ধরনের দেশী-বিদেশী প্রসাধনী, দেশী-বিদেশী ফলমূলসহ দেশী-বিদেশী সকল প্রচলিত পণ্য পাওয়া যায়। গ্রাম এখন শহর। এই গ্রাম শহরে রূপান্তরের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রতিটি গ্রামে স্কুল ও সরকারের অবৈতনিক শিক্ষা এবং বিনামূল্যে পুস্তক দেওয়ার পরিকল্পনা। এতে গ্রামে নারী শিক্ষার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের অর্থনৈতিক হাল ধরেছে নারীরা।

×