ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

গোলাইডাঙ্গায় হানাদারদের ছয়টি নৌকা ডুবিয়ে দেই

গোলাম ছারোয়ার ছানু, মানিকগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:২৭, ৪ জানুয়ারি ২০২৩

গোলাইডাঙ্গায় হানাদারদের ছয়টি নৌকা ডুবিয়ে দেই

টাইগার লোকমান

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। পাক হানাদার বাহিনী রাজধানীজুড়ে গণহত্যা শুরু করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার প্রতিরোধের খবরও জানা যায় সদর থানার ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে। শহরে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। বিরাজ করে থমথমে পরিস্থিতি। ওইদিনই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সে সময়ের মহকুমা প্রশাসকের অফিসে একত্রিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের নির্দেশনা অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত হয় প্রতিরোধ লড়াই শুরু করার। গঠন করা হয় সাত সদস্য বিশিষ্ট কমান্ড কাউন্সিল।

এর সদস্য ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল হালিম চৌধুরীকে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ রাতেই ছাত্র-যুবকদের নিয়ে সরকারি ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্র ও গুলি লুট করে আনা হয়। শুরু হয় প্রশিক্ষণ ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই জেলার সাতটি থানাই পাক হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কৌশল পরিবর্তন করে মুক্তিযোদ্ধারা চলে যান হরিরামপুর থানার দুর্গম চরাঞ্চলে। চালু করেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। দ্রুত বাড়তে থাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সংখ্যাও।
মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হয় জেলার সবচেয়ে বড় যুদ্ধের মূলনায়ক লোকমান হোসেনের (টাইগার লোকমান) সঙ্গে। যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ল্যান্সনায়েক লোকমান বলেন, যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে ছুটিতে বাড়ি আসি। ছুটি শেষ হলেও চাকরিতে আর ফিরে যাইনি। হরিরামপুর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হচ্ছে জেনে যোগ দেই সেই ক্যাম্পে। আমাকে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেন ক্যাপ্টেন হালিম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমান বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা ২২ জুন মানিকগঞ্জে প্রথম আক্রমণ চালায় ঘিওর থানায়। থানার পাশের ক্যাম্প থেকে পাল্টা গুলি চালায় পাক বাহিনীর সদস্যরা। বানচাল হয়ে যায় এসএসসি পরীক্ষা। এই আক্রমণে সবার সঙ্গে আমিও অংশ নেই। প্রথম পরিকল্পনার সাফল্যে উজ্জীবিত হয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। শুরু হয় গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ। এরপর ক্যাপ্টেন হালিম আমাকে পাঠিয়ে দেন সিঙ্গাইর থানার ‘লুডু বাহিনী’র কাছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে মানিকগঞ্জে অনেকগুলো বড় যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় সিঙ্গাইরের গোলাইডাঙ্গায়। কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে এই যুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রাখি।

এই যুদ্ধ সম্পর্কে টাইগার লোকমান বলেন, একদিন হঠাৎ করে আমাদের সোর্স এসে জানায়, আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ হতে পারে। ওই সোর্সের কথা অনুযায়ী আমাদের ছেলেদের ক্যাম্প থেকে চার ভাগে বিভক্ত করে চারটি গ্রামে ছড়িয়ে দেই এবং আমরা প্রস্তুত থাকি। ২৯ অক্টোবর ভোরে শতাধিক পাক বাহিনী খাল দিয়ে সাতটি নৌকায় করে সিঙ্গাইর থেকে গোলাইডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয়েছে বলে খবর পাই। আমরা ওই চার গ্রাম থেকে আমাদের ছেলেদের (মুক্তিযোদ্ধা) নিয়ে পৌঁছানোর আগেই তারা আমাদের পজিশন (অবস্থান) অতিক্রম করে ক্যাম্পের দিকে চলে যায়। পরে আমি সবাইকে বললাম- তোমরা প্রস্তুত হও, ওরা ক্যাম্পে আমাদের না পেয়ে ফেরার সময় এখান দিয়েই যাবে। আমি কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে খালের মোড়ের তিনদিকে পজিশন নেই।  আমার সিগনালের অপেক্ষায় থাকে সবাই। কিছুক্ষণ পরেই পাক সেনাদের নৌকার বহর খালের মোড়ে ঢুকে পড়ে।

আমি প্রথম ফায়ার করে সিগন্যাল দেওয়ামাত্রই তিনদিক থেকে একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধারা। পাল্টা গুলি ছোড়ে পাক সেনারা। অল্প সময়ের মধ্যেই পাক বাহিনীর ছয়টি নৌকা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই। একটি নৌকা গুলি করতে করতে চলে যায়। ওই যুদ্ধে ৮৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। আমরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ হাতে পেয়ে যাই। এরপর পাক সেনারা এই এলাকায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে গানপাউডার ছিটিয়ে ওপর থেকেই গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে শতাধিক বাড়িঘর আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। এ সময় শহীদ হয় আটজন গ্রামবাসী। এই যুদ্ধের সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে সারা মানিকগঞ্জে। এ ছাড়া আরও পাঁচটি বড় যুদ্ধ করেছেন বলে জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমান।    
‘টাইগার লোকমান’ নামকরণের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গোলাইডাঙ্গার যুদ্ধের সময় জীবিত এক পাক সেনাকে থাবা দিয়ে ধরে ফেলি। ওই সময় আমার কয়েক সাথী যোদ্ধা বলেছিল, ‘তুই তো বাঘের মতো করে জ্যান্ত পাক সেনাকে ধরে ফেল্লি, তুইতো টাইগার।’ এরপর থেকে সবাই ‘টাইগার লোকমান’ বলে ডাকে। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান নিজের বাড়ির একটি ঘরে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি যাদুঘর’ গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, জেলার তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার ছবি সংগ্রহ করেছি নতুন প্রজন্মদের উদ্দেশে। এই মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি জাদুঘরে মানিকগঞ্জ জেলায় যত মুক্তিযোদ্ধা আছে সকলের ছবি আমি সংগ্রহ করে রাখার উদ্যোগ নিয়েছি। নতুন প্রজন্মের ছেলে- মেয়েরা এখানে বন্ধের দিনগুলোতে আসে। তারা আমার কাছে জানতে চায় যুদ্ধের কাহিনি, জানতে চায় বঙ্গবন্ধুর কথা।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত জেলার তিন শতাধিক স্কুল-কলেজে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এক ঘণ্টা করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছি। কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলাম, কার ডাকে গেলাম- এ বিষয়গুলো ছেলে-মেয়েদের বোঝাই।
তিনি বলেন, ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ৫৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে শেষ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের পরই মানিকগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। মানিকগঞ্জে  সগর্বে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

×