ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বীর নিবাস থেকে বঞ্চিত অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস

প্রকাশিত: ২০:২৪, ৩ জানুয়ারি ২০২৩

বীর নিবাস থেকে বঞ্চিত অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা

গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মণ্ডল। ছবি: জনকণ্ঠ

আব্দুল আজিজ মণ্ডল। বীর মক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে লড়েছিলেন সামনের কাতার থেকে। বয়সের ভারে এখন নুব্জ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে সামান্য চাকরিও ছেড়েছিলেন। সেই যোদ্ধা এখন থাকেন বগুড়া সদরের বড় টেংরা মধ্যপাড়া এলাকায় অন্যের আশ্রয়ে এক মাদ্রাসা ঘরে। জীবন কাটছে মানবেতর ভাবে। 

অথচ অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাড়ি পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় তিনি আবেদনও করেছিলেন। আশা ছিলো নতুন বাড়ি হবে। শেষ বয়সে অন্তত ভালোভাবে থাকতে পারবেন। তবে সেই স্বপ্ন এখন রীতি মতো দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। 

‘বীর নিবাস’(অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের  আবাসিক নির্মাণ প্রকল্প) তৈরিতে জন্য নিজের আধাপাকা ঘর ভেঙে এখন তিনি গৃহহীন। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আবেদন অনুমোদন  হয়নি। অথচ এক বুক আশা নিয়ে রয়েছেন। শুধু আব্দুল আজিজ নয়। বগুড়ার অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে এমন প্রশ্ন। আর এই প্রাপ্যতার যোগ্য অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার বীর নিবাস নিয়ে শুধু অনিয়ম নয়, উঠেছে দুনীতিরও অভিযোগ। 

এক্ষত্রে সামনের কাতারের রয়েছে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি ব্যয়ে বাড়ি নির্মাণ প্রকল্প- বীর নিবাস, বগুড়ায় নিয়ম অনিয়মের বেড়াজাল ও দুনীতির মধ্যে ডুবে যাওয়ায় স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ির স্বপ্ন। বিপরীতে স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা প্রভাব ও আর্থিক শক্তিতে পাচ্ছেন বীর নিবাসের অনুমোদন। 

আবার শুধু অনিয়ম ও দুনীতিই নয়, নিয়মের বেড়াজালেও প্রাপ্যতার অধিকারে থাকা ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধারা আটকে যাচ্ছেন। তাদের ভাগ্যে স্বপ্নে বাড়ি বীর নিবাস জুটবে কিনা তা কেউই বলতে পারছেন না। কারণ তাদের তো ভূমিই নেই। আর বীর নিবাসের জন্য নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজন অন্ততঃ ৪ শতাংশ জমি। 

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রানালয়ের অধীনে প্রথম পর্যায় ৪ হাজার ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৬ হাজার বীর নিবাস নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ১৬ মার্চ ২০২১ সালে প্রকল্পচি একনেকে অনুমোদন হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রত্যেক উপজেলা থেকে ১২ টি বীর নিবাস নিমার্ণ ছিল। 

ডিপিপি অনুযায়ী, বীর নিবাসের জন্য অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার কমপক্ষে ৪১ গুন ৪৩ ফুট অর্থ্যাৎ ৪ শতক জমি থাকার প্রয়োজনের বিষয়টি উল্লেখ ছিলো। আর এই ৪ শতক জমি থাকার নির্দেশনাতেই অনেক অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা প্রাপ্যতার তালিকায় সামনে থাকলেও অনুমোদনের বাইরে চলে যান। উপজেলা পর্যায় থেকে যাচাই বাছাই করে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর তা অনুমোদন হয়।

অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাস তালিকা তৈরিতে যাচাই বাছাই করেন উপজেলা পর্যায়ের কমিটি। এই কমিটির প্রধান সংশ্লিষ্ট ইউএনও। ৫ সদস্যের কমিটিতে সমাজ সেবা, এলজিইডি, এমপি ও ইউএন’র প্রতিনিধি মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি রয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে এই তালিকা যাচাই বাছাই করে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় এমন কী দুর্নীতিও করা হয়েছে। এমন অভিযোগ সবেচয়ে বেশি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায়। প্রকৃত অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ কাটিয়ে স্বচ্ছল ও প্রভাবশালীদের নামের তালিকা সুপারিশ করে পাঠানোর প্রতিবাদে ও অনুমোদন বাতিলের দাবি জানিয়ে রানীর পাড়া কেল্লাপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ইতোমধ্য আদালতে পৃথক ২টি মামলাও করেছেন। 

সোনাতলা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার সাইফুল ইসলাম জানান সুপারিশ করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়েছে একথা এখন উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে। অভিযোগ রয়েছে,সোনাতালায় বীর নিবাসের জন্য সুপারিশ করিয়ে দেয়ার জন্য বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। মামলার বাদী মকবুল হোসেন জানান, প্রকৃত অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার নাম সুপারিশ না করে যাচ্ছাই বাছাই কমিটি পরস্পর যোগসাজসে ধনী ও বিত্তশালী পরিবারের মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।

অপর দিকে বগুড়া থেকে ১ম ও ২য় পর্যায়ে কতোটি বীর নিবাস অনুমোদন ও নির্মানাধীন রয়েছে সে নিয়ে পাওয় গেছে গরমিল তথ্য। জেলা প্রশাসনের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সেল থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে প্রথম পর্যায়ে জেলায় ৯২ টি বীর নিবাসের অনুমোদনের বিপরীতে ৬টি নির্মানাধীন ও ৮৩টি সম্পূর্ন নিমার্ণ হয়েছে। আর দ্বিতীয় দফায় ২০৮টি বীর নিবাসের বরাদ্দ পাওয়ার পর ১০৩টি নির্মানাধীন ১৭টি সম্পন্ন হয়েছে।

গত বছরের ১০ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে পাঠান অনুমোদন পত্রে দেখা গেছে জেলায় ১৭৩ (বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার) জনের আবাসন বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ অনুমোদন হয়েছে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় ৬৭ টি। এখানেই অনিয়ম দুর্নীতির বেশি অভিযোগ উঠেছে। একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছেন, বগুড়ার অনেক এলাকাতেই বীর নিবাসের নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। 

বগুড়া সদর উপজেলার ইউএনও জানিয়েছেন, সদর এলাকার ১০২ জন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বীর নিবাসের জন্য আবেদন করেছিলেন। এদের মধ্যে ২০ জনের সুপারিশ করে পাঠান হয়। অনুমোদন হয়েছে ৩ জনের নামে। আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আবার ১৪ জনই ভুমিহীন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমর কুমার পাল আরো জানিয়েছেন ভুমিহীন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে বীর নিবাস নির্মানের ক্ষেত্রে স্পষ্ট কিছু নির্দেশনা নেই। তবে স্থানীয় ভাবে খাস জমি পেলে তাদের বিষয়টি দেখা হবে। 

এ বিষয়ে বগুড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রুহুল আমিন বাবলু জানান, যাদের বেশি প্রয়োজন সেই অস্বচ্ছল ভুমিহীনরাই নিয়মের জালে বীর নিবাসের তালিকা থেকে বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অনেক অস্বচ্ছল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি নির্মানের বরাদ্দ পাচ্ছেন না। বগুড়া সদরের বড় টেংরা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম দ্বিতীয় পর্যায়েও সুপারিশে আসেনি। 

অথচ এই মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় রংপুর বেতারে চাকরি পেয়েছিলে। চাকরি করতেন পিয়ন পদে। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের পর বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন বলে তাকে অপদস্ত করা হয়। এর প্রতিবাদেই তিনি চাকরী ছেড়ে দেন।পরে ব্যাংকের পিওন পদ থেকে ৮১ সালে চাকরি চলে গেলে তিনি এলাকায় মুদি দোকানী করেন। বীর নিবাসের জন্য ২০২১ সালে আবেদন করার পর ৩ দফা তার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন যাচাই বাছাই কমিটি। পরে বাড়ির জায়গা বাড়াতে ঘর ভাঙ্গার নির্দেশনা দিয়ে আসে উপজেলা প্রশাসন থেকে। নতুন আবাসন বীর নিবাসের জন্য এর পর তিনি নিজের আধাপাকা ঘর তিনি ভেঙে ফেলেন। 

এদিকে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদা পারভীন জানান, বীর নিবাসের জন্য যাচাই বাছাই তিনি আসার আগে হয়েছে। কিছু অভিযোগ তার কানে এসেছে। তবে লিখিত ভাবে কোন অভিযোগ তিনি পাননি। তিনি জানান, জামুকা থেকে একটি নির্দেশনা এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে যাচাই বাছাই কমিটির কেউ যদি বীর নিবাসের অর্ন্তভুক্ত হন সে বিষয়ে জামুকা সিদ্ধান্ত নিবেন। তার কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে উর্দ্ধতন কর্মকতাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিবেন।

 

এসআর

সম্পর্কিত বিষয়:

×