ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে লুটপাট নিয়মে পরিণত

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ১২ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৯:৩৫, ১২ ডিসেম্বর ২০২২

উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে লুটপাট নিয়মে পরিণত

শিক্ষা অফিসের ওয়েবসাইটের ছবি

লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারিরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন ফান্ড ও স্লিপের টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের নামে দুই কোটি টাকা হরিলুটের তথ্য মিলেছে। কর্মকর্তাদের চাহিদা মতো অর্থ দিতে না পারলে নেমে আসে হয়রানি। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। 

জানা গেছে, জেলার আদিতমারী উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১২৬টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার অবকাঠামো সংস্কার, মেরামত, রং করা বাবদ প্রতিটিতে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। মোট বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকা ( ২০২০ -২০২১ অর্থ বছরে পিইডিপি- ৪ এর আওতায় এডুকেশন ইন এ্যামারজেন্সি খতে বরাদ্দ)।  আবার ১২৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্লিপ ফান্ডের টাকা বরাদ্দ আসে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার টাকা করে (রুটিন ম্যানটেন ফান্ড)। এই ৫০ হাজার টাকা দুই কিস্তিতে ২৫ হাজার,  ২৫ হাজার টাকা করে ৬ মাস পর পর  বরাদ্দ আসে। 

আদিতমারী উপজেলায় এবারের বরাদ্দ আসে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। এই বরাদ্দ ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে জন্য। ১২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্লিপের প্রথম কিস্তির ২৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইতোমধ্যে স্লিপের প্রথম কিস্তির ২৫ হাজার টাকা দেখিয়েছে প্রধান শিক্ষকরা। রেজুলেশনের মাধ্যমে সেই খরচের ভাইচার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিকে জমা দিয়েছে। প্রতিটি ম্যানেজিং কমিটিতে খরচের ভাইচার প্রধান শিক্ষকরা জমা দিলে এই টাকা খরচের ভাইচার নিয়ে বিপত্তি সৃষ্টি হয়।

ঘুষ দেয়ার ভাইচার

আদিতমারীর উপজেলার বাহাদুর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এডক কমিটির অভিভাবক সদস্য মো. নুর আলম জানান, এই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. আবরারা খানম বর্তমানে বদলি হয়ে টেপাপলাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বদলিজনিত কারণে বিদায়ের প্রাক্কালে রেজুলেশনের মাধ্যমে স্লিপের প্রথম কিস্তির টাকা খরচের ভাইচার দিয়ে যায়। 

তার নিজ হাতে লেখা ভাইচারের হিসাবে দেখান, উপজেলা শিক্ষা অফিসার টিও এবং সহকারি শিক্ষা অফিসার  এটিও কে পাঁচ হাজার পাঁচ হাজার করে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছে। জাহাঙ্গীর ক্লাক পাঁচ শত ও হেড ক্লাক কে পাঁচ শত টাকা করে ঘুষ দিয়েছে।  অফিস হতে বই বাবদ দুই হাজার টাকা ও বিদ্যালয় সজ্জিত করতে এবং  পোয়াত ক্রয় বাবদ জনৈক আরিফের মাধ্যমে পাড়ার শিক্ষক মাধ্যমে অফিসকে ৬৫০০ টাকা খরচ দিতে হয়েছে। সোনালি ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে ভ্যাট কেটে রেখে স্লিপের টাকা জমা হয় ২১ হাজার ৮৭৫ টাকা। এর মধ্যে ঘুষ ও অফিস কে খরচ দিতে হয়েছে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। অবশিষ্ট টাকা  মাত্র এক হাজার ৩৭৫ টাকা ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে। একই অবস্থা অবকাঠামো উন্নয়নের দুই লাখ টাকার। এই দুই লাখ টাকার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ১০/১৫ হাজার টাকা খরচ করে বাকি টাকা   কর্মকর্তাদের পকেটে চলে গেছে। এভাবে প্রায় দুই কোটি টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে।

বাহাদুর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. সেফাউল ইসলাম জানান, তিনি স্কুল কমিটির নির্বাচিত সভাপতি হয়েছেন চলতি বছরের ২৫ মে। তার আগে সহকারি শিক্ষা অফিসার মুকুল চন্দ্র রায় ৬ মাসের এডক কমিটি করে করে অনৈতিকভাবে প্রায় ২০ মাস আহবায়ক কমিটি দিয়ে স্কুল পরিচালনা করে  লুটপাট করেছে। 

এর আগে একই দিনে ৬৫টি স্কুলের কমিটির অনুমোদ দিয়ে ছিল উপজেলা শিক্ষা দপ্তর  কিন্তু রহস্য জনক কারনে শুধুমাত্র তার কমিটি অনুমোদন দেয়নি। পরে তদবির করায়  কমিটির অনুমোদন দেয়। বিষয়টি তিনি উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি কোন পতিকার পাননি। বরং নানাভাবে হয়রানি হতে হয়েছে।  

 শরিফুল ইসলাম ও মুকুল চন্দ্র রায়

এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক মোছা. আবরারা খানমকে মুঠোফোনে জিঞ্জাসাবাদ করলে তিনি বলেন, তার পূর্বে স্কুলে খরচের স্লিপটি তিনি নিজ হাতে লিখেছেন। তবে সেই সময় ১টি দুর্ঘটনাজনিত কারণে মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না, তাই কি হতে কি লিখেছেন। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি না করে সামনে এসে দেখা করতে অনুরোধ করেন। বলেন, ছোট চাকরি করি সকলকে ম্যানেজ করে চলতে হয়। ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষা অফিস এই দুইকে সামলাতে গিয়ে হ য ব র ল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান শিক্ষকরা কখনো দুর্নীতি অনিয়ম করতে চায় না। তাদের বাধ্য করা হয়। সংবাদকর্মী রির্পোট করলে বলির পাঠা হতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। 

এদিকে শিক্ষা অফিসার ও সহকারি শিক্ষা অফিসার সম্পর্কে সরকারি প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষক গণের অভিযোগের শেষ নেই। তারা নির্যাতন হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না। প্রাথমিক শিক্ষার দুর্নীতি অনিয়ম উপর হতে নীচ পর্যন্ত। কর্মকর্তাদের কোন কিছু হবে না। প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের শাস্তি হবে। তাদের কে হয়ত চরের দুর্গম স্কুলে বদলি করে দিবে। ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করবে। 

জনৈক প্রধান শিক্ষক জানান, সহকারি শিক্ষা অফিসার ডিপাটম্যান্টে হতে পরীক্ষার মাধ্যমে এটিও হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নৃগোষ্ঠীর কোটা চুরি করে প্রোমশন নিয়েছেন। তিনি নৃ গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নয়। তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মের মানুষ। 

এ বিষয়ে সহকারি শিক্ষা অফিসার মুকুল চন্দ্র রায় জানান, তার বিরুদ্ধে আনিয় অভিযোগ সত্য নয়। তিনি নৃ গোষ্ঠী কোটায় প্রোমশন পাননি। 

আদিতমারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার শরিফুল ইসলাম জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়। জড়িত প্রধান শিক্ষকরা। তারা অন্যায় করে অফিসের না ভাঙায় বাঁচতে। 

এসআর

×