ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী মধুমতি সেতু উদ্বোধন করবেন ১০ অক্টোবর

বদলে যাবে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার অবস্থা

রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ৬ অক্টোবর ২০২২

বদলে যাবে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার অবস্থা

দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা তথা ‘মধুমতি সেতু’র দ্বার খুলছে ১০ অক্টোবর

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত ঢাকা- বেনাপোল ভায়া নড়াইল মহাসড়কের কালনা পয়েন্টে আগামী ১০ অক্টোবর উদ্বোধন হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা তথা ‘মধুমতি সেতু’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটি উদ্বোধন করবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ১০ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মধুমতি সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রস্তুতি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’ নামে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেতুটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়েছে।

এদিকে, সেতু নির্মাণের শেষ পর্যায়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত সংলাপে বলেন, কালনা সেতুর নাম হবে ‘মধুমতি সেতু’।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে মধুমতি সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতুর পশ্চিমপ্রান্তে নড়াইলের কালনাঘাট এবং পূর্বপ্রান্তে গোপালগঞ্জের শংকরপাশা। কালনাঘাট থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে ঢাকার সঙ্গে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনাসহ আশপাশের সড়ক যোগাযোগ কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বিভাগীয় শহর খুলনার দূরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং যশোরের দূরত্ব ১১৩ কিলোমিটার কমে যাবে। এই সেতু চালু হলে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল থেকে কালনা সেতু হয়ে ঢাকার দূরত্ব হবে ২০১ কিলোমিটার এবং যশোর থেকে ঢাকার দূরত্ব হবে ১৬১ কিলোমিটার। বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে বসুন্দিয়া-ধলগ্রাম-নড়াইল হয়ে ঢাকার দূরত্ব হবে ১৯০ কিলোমিটার। একইভাবে নড়াইলের দূরত্ব হবে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার অর্থাৎ কমে যাবে ১৮০ কিলোমিটার।
কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, কালনা বাংলাদেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। সেতুটির  দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। উভয়পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয়  ৯৬০ কোটি টাকা। এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি।

সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, ভাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকা রাখবে। তবে এতদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদী ধারা বিছিন্ন ছিল। সেতু নির্মাণের ফলে সেই বিছিন্নতা আর রইল না। কালনা সেতু চালু হলে শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। ভারত, কলকাতা, অসমসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। নড়াইলের লোহাগড়ায় ইপিজেড (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরনের সড়ক নির্মিত হয়নি। ফলে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’র সুফল পাচ্ছে না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় একটি অংশ। ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর-বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে দুই লেন সড়ক চালু আছে। এই অংশে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পাধীন বলে জানিয়েছেন কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান।

তিনি বলেন, কালনা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে। তাই আপাতত যশোরের মনিহার সিনেমা হল চত্বর থেকে নড়াইলের কালনাঘাট পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি ১৮ফুট প্রশস্ত থাকলেও তা বাড়িয়ে ২৪ ফুট করা হবে। নড়াইল অংশে প্রায় ৪৭ কোটি এবং যশোর অংশে ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক প্রশস্তকরণ করা হবে। এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে।

এ লক্ষ্যে সড়কের দুই পাশে গাছকাটা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে এখনও ছয় ফুট সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ শুরু হয়নি। মধুমতি সেতু চালু হলে এ সড়কে যানবাহনের চাপ সামাল দেয়া অনেক কঠিন হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন চালক ও যাত্রীসাধারণ।
এদিকে মধুমতি সেতুতে বড় ট্রেলার ৫৬৫টাকা, তিন বা ততোধিক এক্সেল বিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০টাকা, দুই এক্সেসল বিশিষ্ট মিডিয়াম ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাওয়ারটিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকাপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটোটেম্পো, সিএনজি অটোরিক্সা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিক্সা, ভ্যান ও বাইসাইকেল পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়াইলে এক নির্বাচনী জনসভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় গেলে নড়াইলের মধুমতি নদীর কালনা ঘাটে সেতু নির্মাণ করবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কালনা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় মধুমতি নদীর উপর কালনা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্প অনুমোদনকালে ২০১৪ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে শেষ হবে বলে উল্লেখ ছিল। এ সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৭০ কোটি টাকা এবং সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ৬৮০ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ১৮.২০ মিটার। তখন কালনা সেতু ছিল চার লেনের।

কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের পর কালনা সেতুর সাথে রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা, জমি অধিগ্রহন ইত্যাদি নানা জটিলতার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়। অবশেষে পৃথক রেল সেতু নির্মাণসহ সব জটিলতা কাটিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ জুন সংশোধিত প্রকল্পে ছয়লেনের সেতু নির্মানের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। তখন প্রকল্পের ৩৬ মাস মেয়াদ ধরে ২০২১ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু করোনার সময়ে কাজ বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের আগেই এ সেতুর নির্মান কাজ শেষ হয়েছে। এই সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলার অপার সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হবে। বদলে যাবে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা।

×