ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই হাজার প্রজাতির গাছ

নীপা-আইয়ুব দম্পতির ঔষধি বাগান

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 নীপা-আইয়ুব দম্পতির ঔষধি বাগান

মৃত্যুসঞ্জীবনী, সন্ধানীকরনী, বিশল্লাকরনী, সুবর্ণকরনী, নাগেশ্বর, তেজবল, কতিলা, পলাশ, আলুবোখারা, জয়তুন, তীন, ভেলা, হীং, কর্পূর, বিশালাঙ্গুলী, বিশা চন্ডাল, গুড়মাড়, মঞ্জিষ্ঠা, আম্র হরিদ্রা, কর্পূর হরিদ্রা, বনরসুন, নিকোচক, কুচিলা, রক্তচিতা, নীলচিতা, পদ্মকাষ্ঠ, রুদ্রাক্ষর, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন, আগর এমন শতাধিক গাছের নাম এক নিশ্বাসে বলে গেলেন কবিরাজ আয়ুব আলী। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কাতিয়ানাংলা গ্রামের আয়ুব আলী হাওলাদার ও নাজনীন আরা নীপা দম্পতি ঔষধি গাছ সংগ্রহে এখন মডেল। তাদের গড়ে তোলা ‘জিনিয়া ঔষধি বাগান’-এ আছে দুই হাজার প্রজাতির দশ হাজারের অধিক গাছ। জীবন রক্ষাকারী গাছ সংগ্রহ করা এখন নীপা-আইয়ুব দম্পতির নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে তারা তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সম্মাননাও লাভ করেছেন। বটিয়াঘাটা উপজেলার কাতিয়ানায়লা বাজারের সামান্য দক্ষিণে আইয়ুব আলীর বাড়িটির রাস্তায় পা দিতেই দুই পাশে দেখা যায় সারি সারি তুলসী গাছ। আর একটু এগুলেই রয়েছে বাসক গাছ। পলাশ, অশোক, চিরতা গাছ এবং শ্বেত ও নীল অপরাজিতা এবং নীলকণ্ঠ ফুলের সমারোহ। একেবারেই ঔষধি গাছে ভরপুর এ বাগানে প্রবেশ করলে অদ্ভুত এক সুগন্ধে বিমোহিত হতে হয়। বোঝাই যায়, নানান গাছ ও ফুলের গন্ধে এক ভিন্ন রকমের আবহ তৈরি হয়ে আছে। নিপা-আইয়ুব দম্পতি সযতেœ তাদের ছোট্ট ঘরটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা ঔষধি বাগানে দুই সহস্রাধিক প্রজাতির প্রায় দশ হাজার গাছে ভরিয়ে তুলেছেন। প্রতিদিন কোন না কোন জায়গা থেকে জীবন রক্ষাকারী নতুন জাতের গাছ সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করেন আইয়ুব আলী। খোঁজ পেলেই যেভাবেই হোক সেই গাছটি তিনি সংগ্রহ করে এনে বাগানে রোপণ করেন। পরে ওই গাছটির ঔষধি গুণাগুণ বের করতে ভেষজ গাছের গুণাগুণ নিয়ে লেখা বই পড়তে শুরু করেন। এলাকায় নীপা-আইয়ুব কবিরাজ দম্পতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আয়ুব আলী হাওলাদারের ‘হাওলাদার’ পদবিটাও কবিরাজের আড়ালে হারিয়ে গেছে। তিনি এখন নাম জিজ্ঞাসা করলে কবিরাজ আয়ুব আলী পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করেন। আলাপচারিতায় আইয়ুব আলী জানান, তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সাগরে মাছের ব্যবসা দিয়ে। ছিল বড় ট্রলার (ইঞ্জিনচালিত নৌকা)। ট্রলারে সঙ্গী-সাথী নিয়ে সাগরে যেতেন জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনতে। সেই মাছ খুলনা শহরে এনে বিক্রি করতেন। দিনে দিনে পুঁজি বাড়ে। ব্যবসাও বাড়ে। একদিন জলদস্যুরা তার ট্রলারে হামলা চালিয়ে নগদ টাকা, মাছ সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। একেবারে প্রায় সর্বস্ব হারিয়ে আইয়ুব দিশাহীন হয়ে পড়েন। এর পর খুলনা শহরের রূপসা ফেরিঘাটের কাছে দোকান দেন। রূপসায় মাছের আড়ত হওয়ার সময় স্থান সম্প্রসারণ করলে উচ্ছেদ হয় তার দোকান। আবারও কাটা পড়ে আইয়ুব আলীর জীবিকার পথ। কি করবেন, কিভাবে চলবেন, সংসারের খরচ কিভাবে আসবে; এই দুশ্চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে প্রায় এক দশক আগে এক এনজিও কর্মকর্তার পরামর্শে আইয়ুব আলী নার্সারি ব্যবসা শুরু করেন। এই কাজে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী নাজনীন আক্তার নীপা। আইয়ুব আলী এখানে-সেখানে ঘুরে ঘুরে গাছের চারা ও গাছের কলম জোগাড় করেন। আর পরম মমতায় স্ত্রী নীপা তার যতœ করেন। নতুন পাতা ছেড়ে সেই গাছ বাড়তে থাকে। সেই টবের গাছ আইয়ুব আলী বিক্রি করেন। নার্সারির ব্যবসা করতে গিয়ে তারা লক্ষ্য করেন বাজারে ঔষধি গাছের চাহিদা এবং দামও বেশি। এ কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ঔষধি গাছের বাগান গড়ে তোলেন। বর্তমানে তাদের ছোট্ট বাড়িটির চারপাশ এবং সংলগ্ন এলাকার প্রায় দেড় একর জমিতে এই বাগান রয়েছে। বাগানে চলতে গিয়ে একটু অসাবধান হলেই হয়তো পায়ের তলায় পিষে যাবে লজ্জাবতীর ডানা বা কোন লতানো গাছের কা-। অল্প জায়গায় বেশি গাছ রাখার জন্য বড় গাছের নিচে ছোট গাছ, গাছের সঙ্গে লতানো গাছ জড়িয়ে দেয়া, সুপারি গাছের তলায় গাছ লাগানো, বরই গাছের তলায় হলুদ গাছের চাষ করা। কয়েকদিন আগে সকাল বেলা তুলসী গাছের সারি দেখতে দেখতে তাদের বাড়িতে ঢুকে দেখা যায়, আইয়ুব আলী জৈব সার দিয়ে মাটি তৈরি করছিলেন, ওই মাটি টবে বসিয়ে গাছের চারা বড় করে তুলবেন। নতুন নতুন অনেক কলম ও টব তৈরির আয়োজন চলছে। কিছুদিন আগে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ তাদের বাগান ল-ভ- করে দিয়েছে। তাই আবারও জোগাড় করার জোর চেষ্টা চলেছে। বাগানে হাঁটতে শুরু করলে আইযুব আলী এক একটি গাছ দেখান আর নাম বলতে থাকেন, কত গাছ আছে আইয়ুব আলীর বাগানে? উত্তরে জানান, দুই হাজার প্রজাতির দশ হাজারেরও বেশি গাছ আছে। প্রায় বিলুপ্ত হতে বসা বহু প্রজাতির গাছও আছে তাদের বাগানে। এখনও নতুন গাছ জোগাড় করে চলেছেন। যেখানে নতুন গাছের খবর পান, সেখানেই ছুটে যান আইয়ুব আলী। সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তার বাগানে; তাই সেটি রাঙ্গামাটি হোক আর ভারতের কোন অঞ্চল থেকে হোক। মোঃ আইয়ুব আলী জানান, ঔষধি গাছের প্রধান ক্রেতা কবিরাজরা। এছাড়া শখের বাগান চাষীরাও তার কাছ থেকে টব অথবা কলমের চারা কেনেন। এসব দেখতে দেখতে তিনিও কবিরাজি শুরু করেন। উপাদান আছে হাতের কাছেই। কিভাবে তা দিয়ে ঔষধ প্রস্তুত করতে হবে, তার কৌশল আয়ত্ত করেছেন শতাধিক কবিরাজি বই সংগ্রহে আছে। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা আইয়ুব আলী এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা নীপা সযতনে কবিরাজিও করেন। তারা জানান, দেশে বহু মানুষ আছেন যারা শারীরিক অসুস্থতায় বাজারে কিনতে পাওয়া যায় এমন ওষুধের পরিবর্তে ঔষধি গাছ থেকে প্রস্তুতকৃত কবিরাজি ঔষধ সেবন করে থাকেন। সে কারণে তারা টিকিয়ে রাখতে চান ঔষধি গাছের এই আয়োজন। গাছ জোগাড় করা, লালন-পালন করা, বিক্রি করা প্রভৃতির মধ্যে কাটাতে চান বাকিটা জীবন। তারা চান বাংলার আনাচে কানাচে জন্মানো গাছের গুণাবলীতে মানুষ উপকৃত হোক, ছড়িয়ে পড়ুক এর আলো। অমল সাহা, খুলনা অফিস থেকে
×