ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা নাটোরের হোসনে আরা

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা নাটোরের হোসনে আরা

হোসনে আরা রহমান নাটোরের একজন অদম্য সংগ্রামী সফল নারী উদ্যোক্তার নাম। যিনি সমাজের শত প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলছেন। সমাজে সফল নারী উদ্যোক্তার পরিচয়ে পরিচিত এই নারী হয়ে উঠেছেন পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের একজন আইডল। বাস্তব জীবনে নানা প্রতিকূলতা ও বাস্তবতার কড়াল আঘাতে বার বার জর্জরিত হলেও থেমে যাননি কখনও। পরিশ্রম, প্রচেষ্টা আর অদম্য সাহস তাকে আজ স্বনির্ভর নারীতে পরিণত করেছে। অভাব অনটনের সংসারে একদিন সুখের দিন আসবে এই আশায় কখনও হাল ছাড়েননি তিনি। নিজ লক্ষ্যে অনড় থেকে লেগে ছিলেন বলেই আজ তিনি সফল। বলছিলাম নাটোর শহরের একজন সফল নারী উদ্যেক্তার কথা। আশির দশকে আমাদের সমাজে নারী স্বাধীনতা, ঘরের বাইরে গিয়ে কিছু করার চিন্তা করা এত সহজ ছিল না। সেই সময় তিনি সাহস দেখান, নারী হয়ে সমাজে কিছু করে দেখানোর। ১৯৬৮ সালে ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম হোসনে আরা রহমানের। তেরো বছর বয়সে ১৯৮১ সালে নাটোরে বিয়ে হয় তার। প্রাথমিকের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই বন্ধ হয়ে যায় তার শিক্ষাজীবন। স্বামীর সংসারে নতুন পরিবেশে খুব অল্প দিনেই মানিয়ে নেন হোসনে আরা। কিন্তু সংসারের অভাব অনটন স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী লুৎফর রহমান বিভিন্ন জায়গায় কাজের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি সেভাবে সফল হতেও পারছিলেন না। এদিকে স্বামীর ক্ষুদ্র আয়ের পাশাপাশি নিজেও কিছু করার চিন্তা করছিলেন হোসনে আরা। কিন্তু লেখপাড়া প্রাথমিক পর্যন্ত হওয়ায় নিজের ঠিক ভরসা করতে পারছিলেন তিনি। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেন তিনি মুরগির খামার তৈরি করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। খুব অল্প পরিসরে দশটি মুরগি পোষা শুরু করেন তিনি। আলাদা জায়গা না থাকায় নিজেদের শোয়ার ঘরেই মুরগিগুলোকে রাখতেন। সে সময় তার এগিয়ে চলায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরিবারের লোকজন। কিন্তু যখন তারা দেখলেন, হোসনে আরা মুরগি পালন করে ধীরে ধীরে লাভের মুখ দেখছেন তখন তারা আর তাকে বাধা দেননি বরং সহযোগিতা করে করেন। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক পর্যায়ে তিনি জিসান পোল্ট্রি হ্যাচারী নামে মুরগির খামার গড়ে তোলেন। ছোটবেলা শখই পরবর্তী জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার সেরা পন্থা হয়ে উঠল। এ যাবৎ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। নাটোর শহরের উত্তর চৌকিরপাড়ে হোসনে আরার জিশান পোল্ট্রি হ্যাচারি আজ শুধু একটি নাম নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রায় চার দশকের সংগ্রাম, ত্যাগ ও সফলতার গল্প। অনেক মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে আজ এই পোল্ট্রি হ্যাচারীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আজ যেখানে সরকারীভাবে উদ্যোক্তা তৈরির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন, সেখানে অনেকদিন আগেই নাটোর শহরের নিভৃতে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সন্তানদের করেছেন শিক্ষিত। পড়াশোনার পাশাপাশি তারাও মাকে সাহায্য করেন। সম্প্রতি ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারণ করতে সম্প্রতি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন হোসনে আরা। বর্তমানে শহরের উত্তর চৌকিরপাড় এলাকায় তার প্রতিষ্ঠিত জিসান পোল্ট্রি হ্যাচারীতে মাদার স্টকে ৫ হাজার পিচ সোনালী কক মুরগি। এখান থেকে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার ডিম উৎপাদন হয়। এই মাদার স্টক থেকে প্রাপ্ত ডিম থেকে নিজ হ্যাচারীতেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মেশিনের সাহায্যে বাচ্চা ফোঁটানো হয়। এই কাজ হোসনে আরা নিজেই দেখভাল করেন। প্রতি বছরে এই হ্যাচারি থেকে উৎপাদন হয় ১৫ লাখ মুরগির বাচ্চা। যা থেকে লাভ হয় কয়েক লাখ টাকা। শুধু আমাদের নয় হোসনে আরার হ্যাচারিতে কাজ করে ভাগ্য বদলেছে অনেকের। কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষের। প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন। তিনি হোসনে আরার খামার ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে কয়েকশ’ নারী খামারীর জীবন। যারা হোসনে আরার হ্যাচারী থেকে মুরগির বাচ্চা কিনে নিয়ে গিয়ে পালন করে বিক্রি করেন। আগামীতে ১০-১৫ বিঘা জমিতে আরও ব্যাপক কর্ম পরিকল্পনা রয়েছে তার। তবে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে সেই পরিকল্পনা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। হোসনে আরা রহমান জানান, আমার জীবনে আজ যা হয়েছে তা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং পরিশ্রমের ফল পেয়েছি আমি। বর্তমান সরকার এসডিজি বাস্তবায়নে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কিন্তু এসডিজি বাস্তবায়নে খামার ব্যবসার উন্নয়নে নিয়ে অনেক কাজ করা বাকি আছে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে খামারকে আরও বড়পরিসরে করা এবং উৎপাদিত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। সে জন্য সরকারীভাবে খামার প্রকল্প থেকে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা না থাকায় অনেক উদ্যোক্তাই আগ্রহ হারান। শুধু সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও খামার থেকে উৎপাদিত ডিম, মুরগিসহ অন্যান্য পণ্য রফতানির ব্যবস্থা করা গেলেই এই শিল্প অনেক এগিয়ে যাবে এবং উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন। বাড়বে বৈদেশিক আয় বলে দাবি করেন জানান তিনি। নাটোরের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা জানান, হোসনে আরার এমন উদ্যোগে অনেকেই অনুপ্রাণিত। বেকারমুক্ত সফল বাংলাদেশ গড়তে হোসনে আরা বেগমের উদ্যোগ অনুকরণীয়। -কালিদাস রায়, নাটোর থেকে
×