ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মনের আলোয় জীবন গড়ার দীপ জ্বালিয়েছে ওরা

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২ নভেম্বর ২০১৯

মনের আলোয় জীবন গড়ার দীপ জ্বালিয়েছে ওরা

দৃষ্টি হারিয়েছে ওরা। হারায়নি সৃষ্টি। অদম্য ইচ্ছা শক্তি। মনের আলোয় জীবন গড়ার দীপ জ¦ালিয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার আলোকিত পথ ধরে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মশিউর রহমানের আকাক্সক্ষা, উচ্চশিক্ষা নিয়ে সে মানব কল্যাণের বাতি জ্বালাবে। এমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে শ্রুতি লেখকের সহায়তায় পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। চোখের আঁধারে মনের সলতেয় আলো জ¦ালিয়ে দিচ্ছে সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যক্রম। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষিত করে তুলতে সরকার সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতায় সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যক্রম শুরু হয় গত শতকে। বগুড়ায় প্রথম এই কার্যক্রম শুরু হয় জিলা স্কুলের স্বল্প পরিসরের একটি কক্ষে। আবাসন ও খাওয়া-দাওয়া ও ব্রেইল সুবিধা না থাকায় এই কার্যক্রমে সফলতা আসেনি। ২০১৬ সালে বগুড়া নগরী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে সুলতানগঞ্জ হাই স্কুলে মাঠের এক কোনায় সীমিত পর্যায়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়। একই বছরে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো স্থাপনা নির্মিত হয়। দি¦তল ভবনে ব্রেইল পদ্ধতিতে পাঠদান, আবাসন, ডায়নিং এবং সম্মুখের মাঠে খেলাধুলা হাঁটাচলা করে শরীর ঠিক রাখা ও যাতায়তের ব্যবস্থা করা হয়। আবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিচিতি হয় নিবাসী। ব্রেইল পদ্ধতি হলো ডট শিক্ষা। ছাপা পাঠ্য পুস্তকের বিষয়কে বিশেষভাবে তৈরি কাগজে অনেক ক্ষুদ্র ছিদ্রের এক ধরনের নক্সা বানিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের হাতে দেয়া হয়। তারা মনের আলোয় ডট নক্সার ওপর আঙুল স্পর্শ করে পড়তে পারে। একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিসোর্স শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে দশজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য একজন রিসোর্স শিক্ষক, আবাসনে একজন হাউস প্যারেন্ট কাম শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের খাওয়া দাওয়ার জন্য একজন কুক (বাবুর্চি) ও নৈশ প্রহরী থাকে। শিক্ষার্থীরা ব্রেইল পদ্ধতি সম্পূর্ণ আয়ত্তে আনার পর তাদের কাছের স্কুলে ভর্তি করিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাঠদানে যুক্ত করা হয়। বগুড়া সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষার্থীরা কাছের সুলতানগঞ্জ হাই স্কুল ও সরকারী শাহ সুলতান কলেজে লিখাপড়া করছে। বগুড়া কেন্দ্রে দশ আসনের আবাসনের মধ্যে ৯ জন শিক্ষার্থী আছে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাঠগ্রহণ করছে অন্তর মিয়া। পঞ্চম শ্রেণীতে আছে হালিম মন্ডল ও ডালিম মিয়া। নবম শ্রেণীতে আছে মশিউর রহমান, জিসান হোসেন, কাওসার ইসলাম, রবিন খান ও মাহমুদ নোমান। নিবাসী কাবিল হোসাইন সরকারী শাহ সুলতান কলজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সে মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। মেধাবী হওয়ায় সরকারীভাবে সে বাড়তি সূযোগ পাচ্ছে। বাকি শিক্ষার্থীরা পিইসি ও জেএসসিতে ভাল ফলাফল করেছে। তাদের প্রতি যত্ন নিয়ে যাতায়াত ও খাবার চিকিৎসায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সরকার থেকে তাদের জন্য পোশাক জুতা ও আনুষঙ্গিক জিনিস দেয়া হয়। হাউস প্যারেন্ট কাম শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ রাশেদুল হাসান। বললেন প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য সরকারী বরাদ্দ ৩ হাজার ৫শ’ টাকা। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সরকারী নানা সহযোগিতা আসে। রিসোর্স শিক্ষক আজিজুল ইসলাম খান বললেন, নিবাসীরা প্রতিটি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করছে। সুলতানগঞ্জ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজলুল করিম বললেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা মেধাবী। মনের শক্তিতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। পরীক্ষার সময় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়। সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক জানান, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা শিক্ষার আলো পেয়ে নিজেদের গড়ে নিচ্ছে। নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মশিউর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পিইসি ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পেয়েছে। তার আত্মবিশ^াস মাধ্যমিকে সে জিপিএ-৫ পাবে (আগামীতে অবশ্য জিপিএ-৫ এর বদলে জিপিএ-৪ থাকবে)। তার আশা, উচ্চশিক্ষা শেষে সে ভাল চাকরি করে মানুষের সেবা করবে। বগুড়া সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যক্রম কেন্দ্রে অন্য জেলার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও আসছে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×