ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইন বৌদ্ধবিহার

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

রাখাইন বৌদ্ধবিহার

এককালের দাপুটে জনগোষ্ঠী সাগরপারের কলাপাড়ার রাখাইন সম্প্রদায় এখন পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জাতি। এ জনগোষ্ঠীকে এখন খুঁজে বের করতে হয়। সরকারীভাবে বলা হচ্ছে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। কালের বিবর্তনের মতো ঝড়ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি, জমিজমা দখল হওয়া, কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পারায় এরা কেউ দেশ ছেড়েছে। কেউবা এলাকা ত্যাগ করে পাহাড়ী অঞ্চলে চলে গেছেন। নামে মাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করে এরা এখন প্রতীকীর মতো বসবাস করছেন। এখনও রয়েছে নামে মাত্র ৩০টির মতো রাখাইন পল্লী। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় শুধু কলাপাড়ায় ছিল ১৫০টি রাখাইন পল্লী। রাখাইন জনসংখ্যা ছিল অন্তত পাঁচ হাজার। বর্তমানে হাজার খানেক। জনসংখ্যা বিলুপ্তির পাশাপাশি রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তিগুলো এখন নিশ্চিহ্নের দ্বারপ্রান্তে। চরম দারিদ্র্য। পুরোহিত না থাকা। বৌদ্ধমূর্তিগুলো চুরিসহ হারিয়ে যাওয়া। বৌদ্ধবিহার সংস্কার করতে না পারা। ঠাকুরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় রাখাইনদের বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার ও ঠাকুরবাড়িগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিংবা প্রত্নতত্ত্ববিভাগ পারে এসব সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে। তাহলে পর্যটনসমৃদ্ধ কলাপাড়া উপজেলার এসব পুরাকীর্তি আদি ঐতিহ্য সংরক্ষিত হবে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বালিয়াতলী ইউনিয়নের পক্ষিয়াপাড়া রাখাইন পল্লী এখনও মানুষ ঘুরতে যায়। মাত্র ১১টি পরিবারের বসবাস রয়েছে। একসময় ছিল অন্তত ৮০টি পরিবার। ৩০ বছরের তথ্য এটি। পদ্ম ফোটা পুকুরটি এখন ডোবায় পরিণত হয়েছে। বৌদ্ধবিহারটির জীর্ণদশা। পুজা করার বৌদ্ধমূর্তি নেই। বিহারের পলেস্তারা খসে পড়ছে। চুনকাম করার পরও যেন শ্রীহীন। জৌলুস নেই। ঠাকুরবাড়িটি ছাড়াবাড়িতে পরিণত হয়েছে। ঠাকুর (পুরোহিত) নেই। টং ঘরটি কুঁজো হয়ে পড়ে আছে। যেন বিধ্বস্তের দ্বারপ্রান্তে। ভিন্ন বৈচিত্রের এ নিদর্শন সংরক্ষণ না করলে আগামী দুই চার বছরে বিলীন হওয়ার প্রবল শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারপরও এ পল্লীর রাখাইনরা এ বিহারে এসে ধর্মীয় আচার পালন করেন। উচ্চশিক্ষিত, রাখাইন নেতা পক্ষিয়াপাড়ার বাসিন্দা বাবু ট্যানথান জানান, এক কথায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। একসময় ইউনিয়নটির নাম ছিল খাপড়াভাঙ্গা। বর্তমানে দুটি ইউনিয়ন করা হয়েছে। তাইতো ঠিকানা ডালবুগঞ্জ। গ্রামটি খাপড়াভাঙ্গা রয়ে গেছে। এ গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশেই একটি রাখাইন মঠসহ বৌদ্ধবিহার। প্রায় দেড় শ’ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরটি মঠসহ সংরক্ষণের প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়ার সাত বছর পরও কিছুই করা হয়নি। উল্টো ২০১২ সালে দেয়া সাইনবোর্ডটিও উধাও হয়ে গেছে। রাখাইন পাড়ার জীর্ণদশার এই বিহারটি এখন চরম বেহালদশা হয়ে গেছে। মঠের উপরের অংশ অনেকটা ভেঙে গেছে। মন্দিরটির স্থাপনাশৈলীতে রয়েছে প্রাচীন আদল। রাখাইনরা এই বৌদ্ধ বিহার কিংবা মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের প্রতি দাবি করে আসছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় অফিসের একটি টিম ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওই এলাকা পরিদর্শন করে চূড়ান্ত একটি প্রতিবেদন প্রস্তাবনা আকারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন বলে তখন জানিয়েছিলেন। ওই টিমের প্রধান খুলনা অফিসের সহকারী গবেষক গোলাম ফেরদৌস বিষয়টি তখন নিশ্চিত করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাগরপারের এই জনপদের রাখাইন জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য ধরে রাখার লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আর বৌদ্ধ মন্দিরটির স্বকীয়তা বজায় রেখে সংস্কার করলে এখানে দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটবে। গৌতম বুদ্ধের দেহধাতু যেমন, চুল ও নখের উপাদানের উপরে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বলে তিনি প্রবীণ রাখাইনদের কাছ থেকে জেনে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশে এই আদলের আরেকটি মন্দির রয়েছে রামুতে। রাখাইন জমিদার ¤্রাথা চৌধুরী ইংরেজদের কাছ থেকে জমি পত্তন নিয়ে খাপড়াভাঙ্গায় বৌদ্ধমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও গোলাম ফেরদৌস জানিয়েছিলেন। পক্ষিয়াপাড়ার বাসিন্দা রাখাইন বাবু ট্যানথান জানান, এই বৌদ্ধ মান্দরটি বৌদ্ধদের আদি থেরোবাদ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ভিন্নতর কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে মন্দিরটিতে। যা ভারতের বিহারের বৈদ্যগয়ার স¤্রাট অশোকের আমলে প্রতিষ্ঠিত কিছু মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। পর্যটন সমৃদ্ধ কলাপাড়ার পর্যটন পল্লী গঙ্গামতি যাওয়ার পরে চরচাপলী বাজারের ঠিক উল্টোদিকে শিববাড়িয়া নদীর উত্তর পাড়ে বৌদ্ধমন্দিরটির অবস্থান। এখনও প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতা রয়েছে মঠটির। খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত। রাখাইনদের ভাষ্যমতে, এই জনপদের বনজঙ্গল সাফ করে বসতি গড়ে তোলার পরে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। ছিল মন্দিরের আশপাশে রাখাইনদের বাড়িঘর, পাড়া। এমনকি মন্দিরের ২০-২৫ হাত দুরে রাখাইন জমিদার মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা ¤্রাথা চৌধুরীকে সৎকার করা হয়। সেই শ্মশানটিও বেদখল হয়ে গেছে। রাখাইনদের ওই স্পটে কোন বাড়িঘর এখন নেই। রয়ে গেছে বৌদ্ধমন্দিরটি। প্রয়াত রাখাইন নেতা উসুয়ে হাওলাদার তাঁর জীবদ্দশায় জানিয়েছিলেন, মন্দিরটির মঠের উপরে স্বর্ণের একটি প্রলেপ ছিল। সেটি ঢাকা ছিল লাল রঙের জড়ি লাগানো কাপড় দিয়ে। কয়েক চোর স্বর্ণালঙ্কার চুরি করতে মন্দিরের মঠের উপরে উঠেছিল। মঠের অগ্রভাগের কাপড় ছিড়ে যায়। তখন বজ্রপাতে একব্যক্তি মারা যায়- অধিকাংশ রাখাইনদের মুখে মুখে এসব শোনা যাচ্ছে। খানিকটা যায় ভেঙে। রাখাইনদের বাংলা বলার আদলে বলা হয়েছিল ‘কাপড়া ভাইঙ্গা গেছে’। এরপর থেকে সেখানকার নামকরণ করা হয় খাপড়াভাঙ্গা। একইভাবে ইউনিয়নের নামকরণ করা হয় খাপড়াভাঙ্গা। এরপরে ইউনিয়টি বিভক্ত করতে গিয়ে খাপড়াভাঙ্গা নামটি বিলোপ করে দেয়া হয়েছে। জীর্ণদশার মন্দিরটিতে ছিল গৌতমবুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। ভেতরে কাঠের ও পাথরের অসংখ্য মুর্তি ছিল। এসবের একটিও নেই। নেই কোন দরজা। মন্দিরটি ইটগুলো জীর্ণদশার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পলেস্তারাসহ ইটের গাঁথুনি খসে পড়ছে। চারদিকে পুরনো ইট-সুরকি ধুলির মতো উড়ে যাচ্ছে। ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে লাল ইটের গাঁথুনি। কোন প্রাণীর কঙ্কালের মতো দেখায়। এখন ধসে পড়া সময়ের ব্যাপার। মঠের চারদিকে মাস্তুল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছে সয়লাব হয়ে ঢেকে গেছে। কাছাকাছি গেলে গা ছমছম করে। এক ধরনের ভৌতিক অবস্থার শিহরণ জাগায় মনে। মঠের উপরে সাপের বসবাস দেখতে পায় বলে স্থানীয়রা জানান। আশপাশের জায়গা সব দখল হয়ে গেলেও সাপের বসবাসের কারণে ভয়ে মন্দিরটি কেউ ভাঙ্গেনি বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রাচীন এই মন্দিরটি দেখতে এখনও কিছু পর্যটক আসেন এখানে। ২০১২ সালে বাঁশের কয়েকটি চেরা চারদিকে দেয়া ছিল। একটি সাইনবোর্ড লটকানো ছিল। যেখানে লেখা ছিল খাপড়াভাঙ্গায় অবস্থিত মন্দিরটি সংস্কার ও দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন বজন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো। তিনি চট্টগ্রাম জেলার ডাবলমুড়িং উপজেলার মোগলতুলি গ্রামের শাখ্যমান বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন বাঁশের বেড়া কিংবা ওই সাইনবোর্ডটি নেই। আর মন্দিরটি মঠসহ যে কোন সময় বিধ্বস্তের শঙ্কা করছেন রাখাইন জনগোষ্ঠী। প্রাচীন এই পুরাকীর্তি রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরী বলে মনে করছেন সচেতন মানুষ। এভাবে কুয়াকাটার ঘাটলায় গৌতমবুদ্ধের শয়নরত বুদ্ধমূর্তি রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। পাশের জায়গা অর্ধেকটা দখল করে নেয়া হয়েছে। এভাবে অন্তত প্রত্যেকটি রাখাইন পল্লীতে একটি বৌদ্ধবিহার ও মঠসহ ঠাকুরবাড়ি রয়েছে। আমখোলা পাড়ার বৌদ্ধবিহার, মঠ ও ঠাকুরবাড়ি দেখতে প্রতিদিন পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু এসবের জীর্ণদশায় সবাই আশাহত হয় এই ভেবে যে, এসব প্রাচীন পুরাকীর্তি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। যাবে বিলুপ্ত হয়ে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কলাপাড়ার উপকূলের রাখাইন জনগোষ্ঠীর এসব পুরাকির্তী এখনই সংরক্ষণ করা জরুরী। এসব বৌদ্ধবিহার, মঠ ও ঠাকুরবাড়ি সংস্কার করে রক্ষাণাবেক্ষণ করলে দর্শনার্থী-পর্যটক আকৃষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে দর্শন ফির মাধ্যমে আয়ের পথও তৈরি হবে। নইলে আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের সাগরপাড়ের কলাপাড়া উপকূলীয় জনপদের ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে না এখানকার কৃষ্টি-কালচার। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×