ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে লেগুনা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত

রাজধানীতে যেভাবে চলেছে অবৈধ ১৫ হাজার লেগুনা

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  রাজধানীতে যেভাবে চলেছে অবৈধ ১৫ হাজার লেগুনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে অবৈধভাবে চলেছে অন্তত ১৫ হাজার লেগুনা। এসব লেগুনার অধিকাংশেরই নেই কোন কাগজপত্র-রুট পারমিট। এমনকি ৮০ শতাংশ চালকের নেই কোন লাইসেন্স। এরপরেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পুলিশ-প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালেছে এ সব লেগুনা। পুলিশের মতে, এসব লেগুনা সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তাই রাজধানী ঢাকা শহরে অবৈধ লেগুনার চলাচল বন্ধের কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার লেগুনা চলাচল করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর, জিগাতলা ও নীলক্ষেত, গাবতলী থেকে মহাখালী, উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে দিয়াবাড়ী, গুলিস্তান থেকে চকবাজার, লালবাগ ও নীলক্ষেত ও বাসাবো, জুরাইন থেকে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী থেকে তাঁতী বাজার, পোস্তোগোলা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মতিঝিল থেকে মুগদা, কাওরান বাজার থেকে রামপুরা ও ডেমরা থেকে যাত্রাবাড়ী। লেগুনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ফার্মগেট, গুলিস্তান, উত্তরা। এসব রুটে অসংখ্য লেগুনা চলাচল করে। গাড়ির কাগজ, ইন্স্যুরেন্স, ফিটনেজ সার্টিফিকেট ও চালকের লাইসেন্স না থাকলেও এতদিন পুলিশের নাকের ডগার ওপর দিয়ে দিব্যি চলেছে লেগুনাগুলো। ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জুরাইন টু গুলিস্তান সড়কে প্রায় ৭০০ লেগুনা চলাচল করে। ট্রাফিক পুলিশের বিশেষ অভিযানের আগে এসব লেগুনার ৯০ শতাংশের কাগজপত্র ছিল না। অভিযানের ফলে ৪০ শতাংশ কাগজপত্র ঠিকঠাক করেছে। এখনও ৫০ শতাংশ গাড়ির কাগজপত্র নেই। লাইসেন্সহীন চালকের সংখ্যা যেখানে ৭০ শতাংশ ছিল কিন্তু অভিযানের পর সেটি ৪০ শতাংশে নেমেছে। কিভাব চলেছে এসব লেগুনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ট্রাফিকের ডিসি থেকে শুরু করে এসি, টিআই ও সার্জেন্ট সবাইকে ম্যানেজ করেই লেগুনাগুলো চলাচল করেছে।’ একই অভিযোগ রয়েছে কাওরান বাজার থেকে রামপুরা রোডে চলাচলকারী লেগুনাগুলোর ক্ষেত্রেও। এ রোডে চলাচলকারী ৯০ শতাংশ গাড়ির কাগজপত্র নেই। এমনকি দুই একজন ছাড়া কোন চালকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। কিভাবে এসব রোডের লেগুনাগুলো চলে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান নামে একজন লাইনম্যান জানান, কাওরান বাজার কিচেন মার্কেটের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ রোডে লেগুনা চলাচল করে। গাড়ি প্রতি প্রতিদিন লাইনম্যানের কাছে ৪০০ টাকা জমা দিতে হয়। সে টাকার ভাগ পুলিশের বড় কর্তা থেকে শুরু করে সার্জেন্ট এমনকি ট্রাফিক কনস্টেবলের পকেটেও যায়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লোকমান হোসেন বলেন, ‘লেগুনা সবাই চালায়। কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা যাতে না ঘটে সে জন্য আমি শুধু দেখভাল করি। এ ছাড়া আমার কোন লেগুনা নেই। আর যে টাকা ওঠে সেই টাকার অংশ সবার পকেটে যায়। প্রশাসন থেকে শুরু করে সাংবাদিক সবাই টাকার ভাগ পায়।’ ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনের সড়ক ও ইন্দিরা রোডে লেগুনা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইন্দিরা রোড থেকে মোহাম্মদপুর ও জিগাতলায় লেগুনা চলে অন্তত দেড় হাজার। প্রতিদিন লাইনম্যানকে জমা দিতে হয় ২০০ টাকা। অজয় সরকার নামে লেগুনা চালক বলেন, ‘আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তবে গাড়ির কাগজপত্র নেই। এ জন্য ২০০ টাকার পরিবর্তে আরও ৫০ টাকা বেশি দিতে হয়। সার্জেন্ট থেকে শুরু করে টিআই, এসি ও ডিসি সবাই টাকা খায়। টাকা খায় তেজগাঁও কলেজের ছাত্রনেতা ও আশপাশে এলাকার নেতাকর্মীরাও।’ গত ৪ আগস্ট ডিএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছেন রাজধানীতে লেগুনা চলাচল করতে পারবে না। শহরতলীতে বা শহরের উপকণ্ঠে লেগুনা সীমিত আকারে চলাচল করতে পারবে। কারণ এসব লেগুনার কারণেই সড়কে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে এসব লেগুনা দায়ী। এসব লেগুনার কোন রুট পারমিট নেই। এমনিতেই লেগুনাগুলো অবৈধভাবে চলাচল করে তার ওপর এসব গাড়ির কোন কাগজপত্র নেই। ড্রাইভারদেরও কোন লাইসেন্স নেই। তাই এখন থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে কোন ধরনের লেগুনা চলাচল করতে পারবে না। লেগুনা বন্ধের সিদ্ধান্তের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর ট্রাফিক পুলিশের বিশেষ অভিযানে লাখ লাখ গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হলেও বিশেষ কৌশলে লেগুনাগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ট্রাফিকের ডিসি থেকে শুরু টিআই, এসি ও সার্জেন্টরা মাসিক হিসেবে এ লেগুনা থেকে টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন, তাই লেগুনাগুলো মামলার আওতায় আসেনি। এতে অনেক সার্জেন্ট দ্বিমত পোষণ করে কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কমিশনার খোঁজ নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, বেশির ভাগ লেগুনার কাগজপত্র নেই, চালকদের লাইসেন্স নেই এমনকি রুট পারমিটও নেই। এইসব কারণে লেগুনা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
×