ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বীরপ্রতীক কাঁকন বিবির লাশ নিজ গ্রামে দাফন

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ২২ মার্চ ২০১৮

বীরপ্রতীক কাঁকন বিবির লাশ নিজ গ্রামে দাফন

নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ ॥ একাত্তরে অনন্য সাহসের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি বীর প্রতীক আর নেই। গত বুধবার রাতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহিরাজিউন)। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার রাত সোয়া ১১টার দিকে এই বীরপ্রতীকের মৃত্যু হয়। শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত সোমবার এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কাকন বিবি। এর আগে গত বছর জুলাইয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন তিনি। জানা যায়, কাকন বিবির জন্ম মেঘালয়ে। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজরে বাস করতেন। কাঁকন বিবি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক নিম্ন মধ্যবৃত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে কাকনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার পরিবর্তিত নাম হয় নুরজাহান বেগম। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে। ১৯৭১ সালে তিন দিন বয়সি মেয়ে সখিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান কাকন বিবি। তিনি বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচরও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাক হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে শুধু গুপ্তচর হিসেবেই কাজ করেননি, সম্মুখ সমরে যুদ্ধও করেছেন বীরত্ত্বের সঙ্গে। প্রায় ২০টিরও বেশী যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। জুনে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন তিনি। বাঙ্কারে আটকে দিনের পর দিন তাকে নির্যাতন করে। ছাড়া পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। একই সঙ্গে চালিয়ে যান গুপ্তচরের কাজ। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলার সম্মুখ যুদ্ধে কয়েকটি গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়। টেংরাটিলা যুদ্ধের পর আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূরবীণটিলা, আধারটিলাসহ বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন কাকন বিবি। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা বীরপ্রতীক ‘নুরজাহান কাঁকন বিবি’র মরদেহ সিলেট থেকে দোয়ারাবাজারে নিজ বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সএ মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তার মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। দোয়ারাবাজারে কাঁকন বিবির মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সর্বস্তরের মানুষ। বিকাল ৪টায় জানাযা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। এর আগে বুধবার রাত ১১টা ১৫ মিনিটে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কাঁকন বিবি। নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে গত সোমবার কাঁকন বিবি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. সুব্রত দেব জানান, গত জুলাই মাসে ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হন কাঁকন বিবি। তখন থেকেই দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে তার। এরপর ছাড়পত্র পেলেও গত সোমবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। অবশেষে বুধবার রাত সোয়া ১১টার দিকে মারা যান একাত্তরে সম্মুখ সমরে লড়াই করা এই বীরাঙ্গনা নারীমুক্তিযুদ্ধা। সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক কাকন বিবির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক. ম মোজাম্মেল হক। বৃহস্পতিবার এক শোকবার্তায় মন্ত্রী তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় মন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে কাকন বিবির অবদান যেকোনো পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কম নয়। তার মতো নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। তার অবদান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা খাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। যা আজও গেজেট আকারে প্রকাশ করেনি মন্ত্রনালয়। কাঁকন বিবির সখিনা বিবি বলেন, আমর মা আমাকে জন্মের পরপরই দেশর জন্য অন্যর হাতে সপে দিয়েছিলেন। আজও আমিসহ পরিবারের সকলকে এই দেশবাসির কাছে রেখে গেছেন এই বাংলাদেশই আমাদের মা। আপনারা আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন জিবদ্দশায় ভুলত্রুটি করে থাকলে ক্ষমা করে দিবেন। ১৯৭১ সালে তিন মাস বয়সী মেয়ে সখিনাকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যান কাঁকন বিবি। প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। পাক বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন এই বীর যোদ্ধা।
×