ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছাগলছিড়ায় বন্দী হয় ১৩৫ হানাদার

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

ছাগলছিড়ায় বন্দী হয় ১৩৫ হানাদার

ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে ২ মে থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধারা মাদারীপুরে ঢোকে। মুক্তিযোদ্ধা তসলিম আহমেদের নেতৃত্বে সদর উপজেলার দুর্গম এলাকা কলাগাছিয়ার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যাম্পে জড়ো হয়ে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। জুন থেকে নবেম্বর পর্যন্ত একে একে নবগ্রাম, উকিলবাড়ি, পাখুল্যা, কালকিনি, কমলাপুর, বাহাদুরপুর, কলাগাছিয়া, চৌহদ্দী, বোলগ্রাম, কলাবাড়ি ও শিবচরে হামলা ও যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা তাদের বিভিন্ন ক্যাম্প ও থানা হেডকোয়ার্টার থেকে সেনা প্রত্যাহার করে মাদারীপুর সাব-ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। শেষে তারা মাদারীপুর থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৪ ডিসেম্বর রাজৈর থানা হানাদার মুক্ত হয়। রাজৈর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকি বাহিনী রাজৈর থানা থেকে পালিয়ে গোপালগঞ্জের মুকসদুপুর ছাগলছিড়া এলাকায় চলে যায়। সেখানে ১৩৫ হানাদার গ্রামবাসীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। রাজৈরের কমলাপুর, পাখুল্যা, লাউসার, কদমবাড়ি, মহিষমারী, ইশিবপুর ও কবিরাজপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয় রাজৈর বড় ব্রিজ, আমগ্রাম ব্রিজ এবং টেকেরহাটে। এর মধ্যে বৌলগ্রাম, রাজৈর থানা ও পাখুল্যায় মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কর্নেল (অব) সরোয়ার হোসেন মোল্যা। সকাল ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত একটানা চলে যুদ্ধ। ঈদের আগের রাতে বৌলগ্রামে পাকবাহিনীকে অবরুদ্ধ করে রাখে মুক্তিযোদ্ধারা। ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পাকবাহিনী রাজৈর ছেড়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলে মুক্তিযোদ্ধারা টেকেরহাট বন্দরে তাদের আক্রমণ করে। তারা পালিয়ে গোপালগঞ্জের ছাগলছিড়ায় গেলে গ্রামবাসী দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রামবাসীর সহায়তায় ১৩৫ পাক হানাদারকে বন্দী করে মুক্তিযোদ্ধারা। ডিসেম্বরের প্রথমেই মাদারীপুরের সব ক’টি থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। এ কারণে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মাদারীপুর শহরের এ. আর হাওলাদার জুট মিলের অভ্যন্তরে ও নাজিমউদ্দিন কলেজে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে তাদের ঘিরে রাখে। ৮ ডিসেম্বর দুপুরে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আবদুল মতিনের ড্রাইভার আলাউদ্দিন কলাগাছিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সংবাদ দেয় যে, ৯ ডিসেম্বর শেষ রাতে পাক বাহিনী মাদারীপুর থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশে পালিয়ে যাবে। এ সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান সদর উপজেলার ঘটকচর থেকে সমাদ্দার ব্রিজের পশ্চিম পাড় পর্যন্ত মহাসড়কের দু’পাশে চার কিলোমিটার জুড়ে অবস্থান নেয়। ৯ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় হানাদার বাহিনী গোলবারুদ, অস্ত্র ও কনভয়সহ তাদের বাঙালী দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস এবং মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঘটকচর ব্রিজ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে হানাদার বাহিনী দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা কনভয় থেকে নেমে কভার ফায়ার করতে করতে আরও দ্রুত এগুতে থাকে। এ সময় হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া কনভয় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ভীত হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে হানাদার ও তাদের দোসরদের একটি অংশ সমাদ্দার ব্রিজের দুপাশে পূর্বে তৈরি বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়ে পাল্টা হামলা চালায়। অপর অংশ দুটি কনভয় ও জীপসহ সমাদ্দার ব্রিজ পার হয়ে রাজৈর থানার টেকেরহাটের দিকে পালিয়ে যায়। তারা টেকেরহাট ফেরি পার হয়ে ফরিদপুর যাওয়ার সময় ছাগলছিড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৩০ পাকিসেনা ও ১২ রাজাকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এদিকে সমাদ্দার ব্রিজে ৯ ডিসেম্বর সারা দিন সারা রাত এবং ১০ ডিসেম্বর সারা দিন সম্মুখযুদ্ধ চলে। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে ১০ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে হ্যান্ডমাইকে পাকি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। এতে সাড়া দিয়ে হানাদার বাহিনী রাইফেলের মাথায় সাদা কাপড় উড়িয়ে বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসে এবং পাশের খাল থেকে পানি, গাড়ি থেকে শুকনো খাবার ও গোলাবারুদ নিয়ে ফের বাঙ্কারে ঢুকে গোলাগুলি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে সন্ধ্যার আগেই হানাদার বাহিনীর মেজর আবদুল হামিদ খটক ও ক্যাপ্টেন সাঈদ ৩৭ পাকিসেনা, ১৪ মুজাহিদসহ মোট ৫৩ জন খলিল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মাদারীপুর শত্রুমুক্ত হয়। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×