ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পলাতক সময় এবং বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ১ এপ্রিল ২০২০

পলাতক সময় এবং বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

এ পাতাতেই কলাম লিখতেন তিনি। এখন যেখানে আমার লেখা ছাপা হয়। তিন চার শ’ শব্দ লিখতেন। সসম্মানে তাকে স্থান দিয়ে নিচে যেত আমার লেখা। ডানে চতুরঙ্গ পাতায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা। দু’হাজার বারো সাল থেকে আমাদের কাগজের বুধবারের সম্পাদকীয় পাতা এভাবেই যাচ্ছে। সম্ভবত পনেরো সাল থেকে তিনি অনিয়মিত হতে থাকেন। কখনও সন্তানের কাছে প্রবাস জীবনযাপনের জন্য। কখনও বয়সজনিত অসুস্থতার জন্য। লেখার পরিসর আরও ক্ষুদ্র হতে থাকে। এক সময় লেখাটা বন্ধই হয়ে গেল। গাফ্ফার ভাই অব্যাহত আছেন এখনও। নিয়ম করে প্রতি মঙ্গলবার লেখা পাঠান লন্ডন থেকে। যথারীতি বুধবারে ছাপা হয়। গত শতকের সত্তর দশকের কোন এক সময় তার সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন অকাল প্রয়াত শক্তিমান কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদ। সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যঞ্জনাময় সে সাক্ষাতকারের সামান্য অংশ তুলে ধরছি। সচেতন পাঠক এ থেকে কিছুটা হলেও তার সম্পর্কে ধারণা পাবেন। ‘অফুরন্ত অন্ধকারে মরা চাঁদ’ শিরোনামে ওই সাক্ষাতকারের দ্বিতীয় প্যারা শুরু হয়েছে এভাবে ‘ঢোলা আদ্দির পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা লাবণ্যময় ভরাট ফর্সা মুখ, কালো ফ্রেমের চশমার ভেতর এক জোড়া সুন্দর চোখ। গভীর এবং তন্ময়। লম্বা বেশি নন- আবার বেঁটেও নন, মাঝামাঝির চেয়ে অবশ্য কিছু কম মনে হয়। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, সামান্য কথায় হেসে ওঠেন এবং সে হাসি ভেতর থেকে কেমন চাপা শব্দে বেরিয়ে আসে। কাঁধের দু’পাশ কাঁপিয়ে সেই মানুষ তার সম্মুখে বসে তখন কথা বলছেন মৃদু কণ্ঠে। চোখ-মুখে কখনও বেদনার ছায়া ঘনিয়ে আসে। কথা বলতে বলতে মনে হয় কী যেন ভাবছেন। হয়ত দেশ, কাল, সমাজ, মানুষ, হতাশা, বিষাদ, অনিশ্চয়তা। পঞ্চাশের যুগের সেই অনেক স্বপ্ন দেখা তরুণ গল্পকার বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সত্তর সালে বসে বোধহয় হিসাব মেলাচ্ছেন। সময় গড়িয়ে গেছে অনেক দূর। পারিপার্শ্বিকের গায়ে প্রগতির হাওয়া লেগেছে অনেক। কিন্তু তবু যেন কোথায় একটা বিপুল ক্লান্তি জমে উঠছে। বাইরের জঙ্গম পৃথিবীটার ভেতরে কোথায় যেন স্থবিরতা অটল হয়ে রয়েছে।’ অসাধারণ সাক্ষাতকারটির উপসংহার কায়েস আহমেদ টেনেছেন এভাবে- ‘নৌকোয় উঠলাম। সেই নৌকোও ভেসে চলল এক সময়। তিনি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর পা ফেলে এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। চারপাশটা একবার বুঝি চেয়ে দেখলেন। গাড়ি থেকে নেমেই বন্যায় ডোবা পরিপার্শ্ব দেখতে দেখতে তাঁর চোখ-মুখে যে কষ্টের রেখা আর বিষণ্ণ নির্জনতা দেখেছিলাম, এখন এত দূর থেকে তা দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখছি সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা একটা মানুষ গাড়ির দিকে এগুচ্ছেন। গাড়িতে উঠবার সময় কি তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন! কী জানি!’ (অগ্রন্থিত কায়েস আহমেদ ॥ গ্রন্থন ও সম্পাদন ॥ প্রশান্ত মৃধা। পৃষ্ঠা-১৮২) ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক আদর্শ এবং পরবর্তীতে তার কর্মপরিধি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে কায়েস আহমেদের লেখার শ্লেষটুকু তাদের কাছে পরিষ্কার। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রও সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম তার প্রতিষ্ঠিত সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রে। নব্বই দশকের প্রথমার্ধে। দৈনিক সংবাদের নারী পাতার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের জন্য তার একটি সাক্ষাৎকারের প্রয়োজন ছিল। সংবাদের নারী পাতার দায়িত্বে তখন শামীম আপা। শামীম আখতার। এখন যিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সমধিক পরিচিত। আমরা কয়েকজন পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করি। শামীম আপার কাপ্তান বাজারের বাসায় যাই। লেখালেখি নিয়ে আলাপ হয়। দুয়েকটা পাঠচক্রও হয়েছিল। ঢাকায় তখন বেশ ক’টি ফিল্ম সোসাইটি সক্রিয় ছিল। অন্যান্য আন্দোলনের মতো চলচ্চিত্র আন্দোলনও সতেজ ছিল। আমরা নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম গ্যেটে ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার, আলিয়ঁস ফ্রঁসেস, রাশান কালচারাল সেন্টার ইত্যাদিতে। শামীম আপার বাসায়ও কয়েকটি চলচ্চিত্র দেখার আয়োজন হয়েছিল, ক্লোজ গ্রুপে। এক সঙ্গে বসে দেখার পর প্রত্যেকে চলচ্চিত্রটির থিম, নির্মান কৌশল, ফটোগ্রাফি, সাউন্ড, মিউজিক ইত্যাদি নিয়ে নিজের মতামত, পর্যবেক্ষণ তুলে ধরত। একবার সুদীর্ঘ আড্ডা হয়েছিল মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে। ‘নারীবাদী’ শামীম আপার সংগ্রহে নারী বিষয়ক প্রচুর বইপত্র ছিল। সিমন দ্য বোভোয়ার এর বিশ্বখ্যাত বই ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় তার ওখানেই। সংবাদের নারী পাতাটি তিনি বেশ সমৃদ্ধ করে সাজাতেন। বি কে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রে যারা কাজ করতেন তাদের অনেকের সঙ্গে শামীম আপার বন্ধুত্ব ছিল। বেশ কিছু মেধাবী নারী জড়িত ছিলেন সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রের বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে। যাদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ‘নারী উন্নয়ন’ বিষয়টি তখনও মোটামুটি বার্নিংইস্যু। সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র এ নিয়ে প্রচুর ‘কাজ’ করছে তখন। প্রকাশনাও বেরিয়েছে অনেক। নিয়মিত জার্নাল নিরীক্ষণে তো লেখা হচ্ছেই। নারী উন্নয়ন এবং বাংলাদেশে নারীর অবস্থা, নারী-পরুষ সম্পর্কের স্বরূপ ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু খসড়া প্রশ্ন নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রে হাজির হয়ে দেখি তিনি ফোনে কারও সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। ফ্রি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা। তার সহকর্মীদের সঙ্গে টুকটাক আলাপ, তারা মিষ্টি ও চা পরিবেশন করেছেন। কিছুক্ষণ পর ফোন ছেড়ে তিনি এলেন। কায়েস আহমেদ বর্ণিত পোশাকের মতো পোশাক পরা। শুধু পাঞ্জাবির জায়গায় ফতুয়া। কুশল জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘বলুন কি জানতে চান।’ তখনও আমার ছাত্রত্ব শেষ হয়নি । আর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ার কাছাকাছি বয়সে। তবু আপনি করেই সম্বোধন করেছিলেন। মিষ্টি খাওয়া শেষ হয়নি তখনও। হেসে বললেন, ‘খান, মিষ্টি খেতে খেতে মিষ্টি মুখে কথা বলুন।’ বলে আবার হাসেন। অবিকল কায়েস আহমেদের বর্ণনার মতো। নিখুঁত বর্ণনা করেছেন বিরলপ্রজ কথাসাহিত্যক। তিনি যে বলেছিলেন, ‘পঞ্চাশের যুগের সেই অনেক স্বপ্ন দেখা তরুণ গল্পকার বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সত্তর সালে বসে বোধহয় হিসাব মেলাচ্ছেন।’ কথাটা প্রতীকী হয়ে ওঠে মার্কসবাদী বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে সত্তর দশকের ‘নতুন উন্নয়ন কৌশল’-এ অন্তর্ভুক্ত হতে দেখে। গত শতকের সত্তর দশকের শুরুতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সংস্থা অনুন্নত দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল। যার নাম ছিল ‘নতুন উন্নয়ন কৌশল।’ বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর তহবিলও সরবরাহ করেছিল। তখন অনেক বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিভিন্ন নামে দ্রুত আত্ম প্রকাশ করে। এদের মূল কাজ ছিল গ্রামে। সে সময় দেশে ‘গ্রামোন্নয়ন’-এর ঢেউ উঠেছিল। দারিদ্র হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি গালভরা নানা নামে এসব সংস্থা তখন দুর্বার গতিতে কাজ করেছে। তাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য কতটা দূর হয়েছিল নিশ্চিত করে বলা না গেলেও সংস্থার কর্ণধারদের জীবনে আর্থিক পরিবর্তন শুধু চোখে পড়ার মতো নয়, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার স্তরে পৌঁছেছিল। মূলত গ্রামে কাজ করলেও শহরে ও বিভিন্ন নামে এসব সংস্থা কাজ করেছে। সত্তরের শুরুতে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর পর মধ্য সত্তরে দাতাদের মনোযোগের কেন্দ্রে অসে ‘নারী উন্নয়ন কর্মসূচী।’ নারীর অধস্তন অবস্থা নিয়ে গবেষণা করার জন্য নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান ‘গলদঘর্ম হয়ে কাজ’ শুরু করে তখন। উন্নয়নের এসব ধারা নব্বই দশক পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রের জন্ম গবেষনাময় সেই সত্তর দশকে। জনকণ্ঠে কলাম লেখার সুবাদে বহু বছর পর আবার প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ হয় তার সঙ্গে। আমার কলামগুলো নিয়মিত পড়তেন, হয়ত একই পাতায় প্রকাশিত হতো বলে। নইলে এ নগণ্য লেখকের লেখা তিনি পড়বেন কেন। তারওপর ফোনে আবার প্রতিক্রিয়া জানানো। ফোনে তার কণ্ঠস্বর ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। মনেই হতো না তার বয়সী মানুষ কথা বলছেন। ভীষণ তরুণ আর প্রাণবন্ত লাগত কথাগুলো। ‘মিলু শামস, আমি জাহাঙ্গীর বলছি।’ প্রতিবার ফোনে কথা শুরু করতেন এভাবে- আর প্রায় প্রতিবারই আমি দ্বিধান্বিত হয়ে ধাক্কা খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিতাম। সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে আশির দশকের সাভারের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা ছিল। দক্ষিণা রঞ্জন মিত্র মজুমদারের জন্মগ্রাম সাভারের উলাইলের প্রসঙ্গ ছিল এবং তুলনামূলক আলোচনার অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের প্রসঙ্গ ছিল। লেখাটি পড়ে তিনি ফোনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন এবং আমার কলামগুলো নিয়ে একটি বই করার কথা বলেছিলেন। বই করার কথা তিনি আগেও বলেছেন কিন্তু ওই লেখাটা পড়ার পর থেকে যখনই কথা হয়েছে বইয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে ভোলেননি। বই প্রকাশের ব্যাপারে আমার সীমাহীন আলস্য এবং ঔদাসীন্য কাটাতে তার ভূমিকা অন্যতম। এ জন্য তার প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। তার মৃত্যুতে এসব কথা মনে পড়ছে। কত সহজে একজন মানুষ ‘নাই’ হয়ে যায়! সামনে ঈদ সংখ্যা আসছে। এবার আর তার কাছে লেখা চাওয়া হবে না। একবার ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা পাঠিয়ে তিনি ছোট্ট চিরকুট পাঠিয়েছিলেন- ‘মিলু শামস প্রিয় বরেষু ঈদ সংখ্যার জন্য একটা গল্প পাঠালাম। ভাল লাগলে ছাপাবেন। আমি ২ জুন টরন্টো চলে যাব। ফিরব মাস ছয়েক পর। গল্পের কপিটা আপনার কাছে রেখে দেবেন। ফিরে এসে নেব। ধন্যবাদান্তে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।’ আরেকবার কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারির আগে লিখেছিলেন- ‘মিলু শামস প্রিয় বরেষু বুধবারের লেখার সঙ্গে একুশের জন্য একটা গল্প পাঠালাম। আশা করি আপনার ভাল লাগবে। শুভেচ্ছান্তে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।’ আরও একবার একুশে সংখ্যার আগে- ‘মিলু শামস প্রিয় বরেষু ১. ২১ এর লেখাটা পাঠালাম। ২. বুধবারের লেখাটাও পাঠালাম। শুভেচ্ছান্তে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আপনার পা-ুলিপির খবর কি?’ এ রকম বেশ কিছু চিরকুট লিখেছিলেন তিনি। বছর কয়েক আগের কোনো এক বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল তার বই ‘ইলামিত্র এই সন্ধ্যাটা যদি দেখে যেতে পারতেন।’ অটোগ্রাফসহ বইটা আমাকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘পড়ে যদি দু’লাইন লেখেন খুব খুশী হব।’ বইটা পড়েছিলাম। কিন্তু লিখবো লিখবো করেও শেষ পর্যন্ত আর লেখা হয়ে ওঠেনি। লেখার কথা ছিল দু’হাজার পনেরতে প্রকাশিত তার ‘প্রাচীন কালের যে-সব ভয়’ নামের চমৎকার গল্পের বইটি নিয়েও। তাও অসম্পন্ন থেকেছে। খারাপ লাগছে। এরকম ছোটখাটো কত কথা, অনুরোধ, আবদার বা দাবি ব্যস্ততার কারণে আমরা ভুলে যাই। তারপর মানুষটি চিরতরে চলে গেলে স্মৃতি কেবলই পীড়িত হয়। চুরাশি বছর বয়সে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর চলে গেলেন গত তেইশ মার্চ।
×