ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ২১ মার্চ ২০২০

 মুক্তিযোদ্ধার ভালবাসা

‘না, তিনি কোন পাগল নন বা কোন আধ্যাত্মিক সন্ন্যাসীও নন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা’। একাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। তবে তার সাংসারিক অবস্থা বেশ নাজুক। দেশ স্বাধীনের পর ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট এদেশের বিশ্বাসঘাতকের দল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে তখন তিনি চরম মর্মাহত হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি চুল কাটবেন না। শুধু তাই নয়, টানা প্রায় ৪৫ বছর যাবত তিনি মাথায় তেল দেননি, চুলে চিরুনি লাগাননি। এমনকি চুল ও কাটেননি তিনি। তার শয়ন ঘরে চারদিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি আর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচীর ব্যানার পোস্টার দিয়ে ঘর সাজিয়ে রেখেছেন। এ যেন জাতির জনকের প্রতি বিরল ভালবাসার দৃষ্টান্ত। রাণীনগর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা হতদরিদ্র দিনমজুর জহির উদ্দিনের দিন কাটে একটি মাটির ঘরে। বয়সের ভারে কিছুটা কাতর হলেও শারীরিক শ্রম দিয়ে টাকাপয়সা উপার্জনের ক্ষমতা প্রায় শূন্যের ঘরে। তার পরেও বিরল ভালবাসার টানে ভাল কাজ করতে গিয়ে জীবনে তার অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ঠিক এমই একজন মানুষ নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার আনালিয়া খলিসাকুড়ি গ্রামের মৃত-মছির উদ্দিনের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভালবাসার কারণে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে সাধ্যমতো মাঝে মধ্যেই দোয়া মাহফিল করেন জহির উদ্দিন। তার আপসোস মুক্তিযাদ্ধা হয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের সেলামি দিতে না পারায় সরকারী কোন সুযোগ-সুবিধা অদ্যাবধি পাননি তিনি। নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়নের আনালিয়া খলিসাকুড়ি গ্রামের মৃত মছির উদ্দিনের পুত্র এই মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন (৬৭)। জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ মাতৃকাকে শত্রু মুক্ত করার লক্ষ্যে ভারতের শিলিগুড়ি ও মধুপুর ক্যাম্পে প্রায় ৩মাস প্রশিক্ষণ শেষে তার যুদ্ধকালীন ক্যাম্প কমান্ডার উপজেলার সিম্বা গ্রামের মৃত তসলিম উদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন তারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন সোনার বাংলা গড়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছিলেন, ঠিক সেই সময় ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট কিছু উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী রাজাকার আলবদর তথা স্বাধীনতা বিরোধীদের মদদপুষ্ট গুটিকয়েক সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির জনকের হত্যা খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানার পর বিরল ভালবাসার টানে রাগে ক্ষোভে প্রতিজ্ঞা করেন এই জহির উদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের এবং রাজাকার আলবদর আল সামসদের বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মাথায় তেল চিরুনী দেব না এবং চুল আর কাটব না। সে অপেক্ষায় আছেন আজ প্রায় ৪৫ বছর ধরে। উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ক্রমিক নং ৫৯ জহির উদ্দিনের নাম থাকলেও রহস্যজনক কারণে সরকারীভাবে কোন সুযোগ-সুবিধা তার ভাগ্যে জোটেনি আজও। অথচ জেলা সদরে গত ২০০০ সালে ৬মার্চে মুক্তিযোদের মিলন মেলা অনুষ্ঠানে নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীলের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক সভাপতি ‘মুক্তিযোদ্ধা ৭১’ নওগাঁ জেলা শাখা থেকে তাকে দাওয়াত পত্র দেন। কয়েক দফায় তালিকাভুক্তের আবেদন করেও মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্তির তালিকায় তার নাম স্থান পায়নি। নিজের পৈত্রিক কোন জমাজমি না থাকলেও শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকার সুবাদে তার শ্বশুর একখন্ড জমি দিলে সেখানে মাটির দেয়াল তুলে কোন রকমে রাত কাটাচ্ছেন। যে ঘরে বসবাস করছেন সেটাও যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×