ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু শরণার্থীদের ওপর জবরদস্তি নয়

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 জলবায়ু শরণার্থীদের  ওপর জবরদস্তি নয়

জলবায়ু শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। সম্প্রতি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রশান্ত মহাসাগরীয় গবেষক কেট বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী নজির স্থাপন করেছে। এতে বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্র শরণার্থীদের এমন কোন দেশে ফিরিয়ে দিতে পারে না, যেখানে মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা হচ্ছে, যেখানে জলবায়ু সঙ্কটের কারণে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং যেখানে অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণের ঝুঁকি রয়েছে। খবর ইয়াহু নিউজের। যদিও এই রায় বাধ্যতামূলক নয়, তবে জলবায়ু সঙ্কটে যাদের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তাদের রক্ষা করার জন্য প্রতিটি দেশের আইনী দায়িত্ব রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে সমুদ্রপৃষ্ঠের স্তরকে শরণার্থীদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ উল্লেখ করে সুরক্ষা চাওয়া আইওন তেতিওতার করা মামলার পর্যালোচনা করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি এই রায় দিয়েছে। দ্বীপটি মূলত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ কিরিবাতি থেকে আগত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ডুবে যাওয়া প্রথম দেশ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, তার দাবি জলবায়ু সঙ্কট নিরাপদ পানীয় জলের ঘাটতি পূরণ কঠিন করে তুলেছে এবং তিনি ভূমির বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ২০১০ সালে তার ভিসা শেষ হওয়ার পরে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে যেতে বাধ্য হন এবং সেখানে তিনি শরণার্থী মর্যাদার জন্য আবেদন করেছিলেন। হাওয়াই ও অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেক পথের দ্বীপ দেশ কিরিবাতি অনেকটা স্বর্গের মতো। তবে জীবনের এই পথটি এখন হুমকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দ্বীপের অস্তিত্বকে অতি দ্রুত তলিয়ে দিতে পারে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে তার দক্ষিণ দ্বীপটি আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে, তাই তার এবং তার পরিবারের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলো জনবহুল হয়ে ওঠার ফলে দক্ষিণ তারাওয়া জনবহুল হয়ে পড়ছে। অনেককে দক্ষিণ তারাওয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই দ্বীপে ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৪৭ সালে। তখন দক্ষিণ তারাওয়ায় মাত্র ১৬৭১ জন লোকের বসবাস ছিল। কিন্তু ২০১০ সালের মধ্যে এখন ৫০ হাজারেরও বেশি লোক বসবাস করছে। জনবহুল হয়ে পড়া এই দ্বীপে সহিংসতা বেড়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এতে মিঠা পানির অভাব রয়েছে এবং কৃষি কাজের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডের তেতিওতার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। যেহেতু কিরিবাতি কেবল ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে অবিশ্বাস্য হয়ে উঠবে তাই কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় কিরিবাতি প্রজাতন্ত্রের কাজগুলোকে হস্তক্ষেপের অনুমতি দিতে পারে। যেখানে সুরক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে জনসংখ্য স্থানান্তরিত করতে হবে। বিশ্বে ক্রমশ বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু শরণার্থী সমস্যা মোকাবেলায় বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু প্যারিস চুক্তির কোন উদ্দেশ্যই এখন পর্যন্ত সফল তো হয়নি, উল্টো চুক্তি থেকে বের হয়ে গেছে এর অন্যতম অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আগামী তিন দশকের মধ্যে ১৪৩ মিলিয়ন জলবায়ু শরণার্থী বিশ্বের তিনটি দেশে আশ্রয়ের চেষ্টা চালাবে। ফলে সৃষ্টি হবে অপরিসীম মানবিক বিপর্যয়। গ্রাউন্ডশেলের ২০১৮ সালের রিপোর্টে বলা হয়, সাব-সাহারান আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ুজনিত সমস্যায় এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ছাড়া শস্যক্ষেত্র নষ্ট, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য মতে, জলবায়ু শরণার্থীদের একটি বড় অংশই শহরমুখী হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণে। গবেষণা সংস্থা গ্রাউন্ডশেল আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ৪ কোটি, লাতিন আমেরিকায় ১ কোটি ৭০ লাখ এবং সাব-সাহারান অঞ্চলে ৮ কোটি ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ নিকোলাস স্টার্ন ২০০৬ সালেই সতর্ক করে বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শরণার্থী বিষয়টি হতে যাচ্ছে আগামী সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘অতীতের জলবায়ুজনিত সংঘাত সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। বর্তমানেও পশ্চিম আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ায় এই জলবায়ু শরণার্থী সমস্যা সহিংসতার রূপ নিতে পারে।’ যা আমরা ২০১১ সাল থেকে এর মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় প্রত্যক্ষ করছি। বিশ্ববাসীর সবার চোখের অন্তরালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল তুভালু দ্বীপ পানির গর্ভে চলে গেল। এই দ্বীপটির বাসিন্দারা সাগর পেরিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিকট ভবিষ্যতে আরও এমন অনেক অঞ্চল সাগরগর্ভে হারিয়ে যাবে, যদি এখনই বিশ্ববাসী জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে প্রকৃতিবান্ধব পদক্ষেপ না নেয়।
×