ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বরিশালের থানা পুলিশেও ছিলো ডিআইজি মিজানের প্রভাব!

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

বরিশালের থানা পুলিশেও ছিলো ডিআইজি মিজানের প্রভাব!

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বর্তমান সময়ে সর্বাধিক আলোচিত সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিআইজি মিজানুর রহমান মিজানের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলাতেও তার (মিজান) বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষমতার প্রভাবে গত কয়েক বছর ধরে মেহেন্দিগঞ্জ থানা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন তার (মিজান) ছোট ভাই মোঃ স্বপন এবং তিন বোনজামাতা। মেহেন্দিগঞ্জ থানা পুলিশের যাবতীয় তদবির বাণিজ্য, আসামি ধরা-ছাড়া, জিডি, মামলা, চার্জশিট সবই হতো ডিআইজি মিজানের ছোট ভাই স্বপন ও তার তিন বোনজামাতার ইশারায়। অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে বিয়ে করাসহ নানা অপকর্মের জন্য প্রত্যাহার হওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের অপরাধের ফিরিস্তি বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে। সেই সাথে তার স্বজনদেরও পুলিশ প্রশাসনে সুযোগ সুবিধার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিআইজি মিজানের ছোট ভাই স্বপনের অনৈতিক আবদার না রাখায় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বদলি করে দেয়া হয় মেহেন্দিগঞ্জ থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহানকে। মেহেন্দিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে একটি ফার্মেসি রয়েছে মিজানের ছোট ভাই স্বপনের। ওই ফার্মেসিতে বসেই পুলিশের সব বিষয়ে খবরদারি করা হতো। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মেহেন্দীগঞ্জের পৌর শহরের আম্বিকাপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আকবরের দুই পুত্র ও ছয় কন্যার মধ্যে তৃতীয় মিজানুর রহমান। একসময়ে অভাব-অনটনের মধ্যেই চলতো তাদের সংসার। একটি ছনের (কাঁচা) ঘরে বসবাস ছিল পুরো পরিবারের। বৃষ্টির সময় পানি চুয়ে পড়তো পুরো ঘরে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও ছোট বেলা থেকেই মিজান ছিলেন মেধাবী। ১৯৮০ সালে মেহেন্দিগঞ্জের পাতারহাট পিএম স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন তিনি (মিজান)। ৮২ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন স্যার এফ রহমান হলে। স্থানীয়রা জানান, মিজানের পুলিশ বিভাগে চাকরি হওয়ার পর পরই ভাগ্য খুলে যায় পুরো পরিবারের। রাতারাতি দুই হাতে অর্থ কামিয়ে কয়েক বছর আগে মেহেন্দিগঞ্জ পৌর শহরের পাতারহাট-উলানিয়া সড়কের পাশে কালীকাপুর এলাকায় প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন ‘আমেনা ভিলা’ নামের বিশাল বাউন্ডারি ঘেরা বিলাসবহুল দোতালা বাড়ি। মেহেন্দিগঞ্জবাসীর কাছে ওই বাড়িটি ‘স্বর্ণকমল’ হিসেবে পরিচিত। ঢাকার পল্টনসহ বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে তার (মিজান) একাধিক ফ্লাট-বাড়ি রয়েছে বলেও তার ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন। অগাধ অর্থ সম্পদের মালিক মিজানের দুই পুত্রসহ স্ত্রী থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তার দুই পুত্র সেখানেই পড়াশোনা করেন। অস্ট্রেলিয়ায় তিনি (মিজান) বাড়িও করেছেন বলে তার ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেহেন্দিগঞ্জের এক সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, শুধু মেহেন্দিগঞ্জে নয়, ঢাকা পুলিশ হেড কোয়ার্টারের যাবতীয় নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন ডিআইজি মিজান। অবৈধ এ বাণিজ্য করে তিনি অগাধ টাকার মালিক হয়েছেন। মেহেন্দিগঞ্জে তেমন একটা আসা-যাওয়া না থাকলেও ঈদ এবং কোরবানির সময় এলাকায় আসতেন তিনি। এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দরিদ্রদের মধ্যে ডিআইজি মিজান অনেক দান-সদকা করতেন বলে জানিয়েছেন ওই সাবেক সংসদ সদস্য। মেহেন্দিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন খান বলেন, একসময় ছাত্রলীগ করতেন মিজান। পরে পুলিশে চাকরি নেন। এলাকায়ও তেমন আসেন না। তবে মেহেন্দিগঞ্জে একটা সুন্দর বাড়ি করেছেন। সবাই ওই বাড়িটিকে ‘স্বর্ণকমল’ হিসেবেই চেনেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেহেন্দিগঞ্জ থানার তৎকালীন চৌকস এসআই মোঃ শাহজাহান পাতারহাট বন্দরে কাগজপত্রবিহীন একটি মোটরসাইকেল আটক করার পর ডিআইজি মিজানের ক্ষমতাধর ভাই স্বপন মোটরসাইকেলটি ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু এতে রাজি হননি এসআই শাহজাহান। ডিআইজি মিজানের ভাইয়ের অন্যায় আবদার না রাখায় এসআই শাহজাহানকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় বাবুগঞ্জের আগরপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে। বর্তমানে তিনি (শাহজাহান) আগৈলঝাড়া থানার এসআই হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত রয়েছেন। ডিআইজি মিজানের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তার ভাই ও তিন বোনজামাতার দাপটের বিষয়ে ওই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মিজান ও তার ভাই। ওই সংবাদের প্রেক্ষিতে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে দিয়ে মেহেন্দিগঞ্জের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যে চাঁদাবাজি মামলা করান ডিআইজি মিজান। ওই মামলায় বরিশালের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক কর্মকতার ওপর অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র পর্যন্ত দাখিল করিয়েছেন ডিআইজি মিজান। পরবর্তীতে ওই মামলার বাদী আদালত থেকে মামলা তুলে নেয়ায় ডিআইজি মিজানের রোষানল থেকে বেঁচে যান স্থানীয় তিন সাংবাদিক। মিজানের রোষানল থেকে বেঁচে যাওয়া মেহেন্দিগঞ্জের সাংবাদিক সঞ্জয় গুহ জানান, ডিআইজি মিজানের ক্ষমতার দাপটের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করার পর ডিআইজি মিজান ও তার ভাই স্থানীয় সাংবাদিকদের দেখে নেয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। এর এক সপ্তাহ পর তার অনুগত এক ইউপি সদস্যকে বাদি করে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন খোকন, তিনি (সঞ্জয় গুহ) এবং সঞ্জয় দেবনাথের বিরুদ্ধে আদালতে মিথ্যে চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করানো হয়। ওই মামলায় আদালত পিবিআইকে তদন্ত প্রতিদেন দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু পিবিআই’র তৎকালীন পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন সরেজমিন তদন্ত না করেই ডিআইজি মিজানের প্রভাবে বরিশালে বসেই তাদের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন।
×