ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পিন্ডির প্রলাপ ॥ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কমেন্ট্রি -তোয়াব খান

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

পিন্ডির প্রলাপ ॥  স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কমেন্ট্রি   -তোয়াব খান

কমেন্ট্রি ॥ গোয়েবলসের প্রেতাত্মা জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খান আর তার জল্লাদ বাহিনীর তোতা পাখিগুলো সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একই শেখানো বুলি আউড়ে চলেছে রেডিও গায়েবী আওয়াজে। গ্রামোফোন কোম্পানির কুকুরের ছবিওয়ালা সেই রেকর্ডের মতো। পিন দিয়ে চড়িয়ে দিলেই হলো কলের গান বাজতে শুরু করবে। বাঁধাগতে গান হবে। সকাল-সন্ধ্যা-রাত, যখনই খুলুন না কেন, পড়ানো লব্জই তোতার একমাত্র পুঁজি। সকাল বেলা উঠলেই শুনতে পাবেন, ‘অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে’। দুপুরে- ‘দেশপ্রেমিক জনসাধারণ দুষ্কৃতকারীদের প্রশ্রয় দেন নাই, বরং সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন’। এরপর রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিন পাল্টে দেয়া হবে। আর তোতার কণ্ঠে শোনা যাবে- ‘একদল অনুপ্রবেশকারী আমাদের সীমান্তের কয়েক শ’ গজ ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আমাদের সেনাবাহিনী শুরুতেই তাদের বাধা না দিয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। পরে সময়মতো আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অনুপ্রবেশকারীরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়’। এরপরই অস্ত্রপাতির একটি লম্বা ফর্দ পেশ করা হয়। হতাহতের সংখ্যা নেই বলে উল্লেখ করা হয়। সবশেষে বলা হয় ‘কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে’। দিনের পর দিন তোতার কণ্ঠে ‘রেডিও গায়েবী’ আওয়াজের এ বাণীই শুনতে পাওয়া যাবে। অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাও আবার বাড়তে-বাড়তে হয়ে যায় কয়েক হাজার। কিন্তু তোতার প্রভুর কয়জন বরকন্দাজ মারা গেল সে সম্পর্কে গায়েবী আওয়াজ একেবারেই চুপ। সমরবিদ্যার সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিরও পেটের পিলে এ জাতীয় কথাবার্তা শুনে ফেটে যেতে পারে হাসতে-হাসতে। সীমান্তের কয়েক শ’ গজ ভেতরে। হতাহতের সংখ্যা কথা উল্লেখ নেই। কয়েকজন গ্রেফতার-অর্থাৎ সঠিক সুস্পষ্ট কোন তথ্য তোতার মুখে ভুল করেও শোনা যাবে না। যদি প্রশ্ন করা হয়, মাথা খারাপ হয়েছে ও কথা মুখে আনবেন না। কোন তথ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা সাফ মানা। তার ওপর তোতা কি প্রশ্ন করতে পারে? কিন্তু মুশকিল হয়েছে গ্রামোফোন কোম্পানির তোতা আর তার প্রভু ছাড়াও বাইরের যে জগতটি রয়েছে তাকে নিয়ে। তাঁরা তো তোতা নয়, তাই প্রশ্ন তারা তুলছে। বলছে, হাতে কোন সুস্পষ্ট তথ্য থাকলে ছাড়ুন না। কয়েক হাজার অনুপ্রবেশকারী কয়েক শ’ গজ ভেতরে, কয়েকজন গ্রেফতার হতাহত নেইÑ এসব কথা শুনলে তো পাগলেও হাসবে। বাংলাদেশে কি ঘটেছে বা এখন কি ঘটছে সে সম্পর্কে তোতার মুখের কাহিনী ছাড়া অন্য কিছু যাতে দুনিয়ায় প্রচারিত না হয় তার জন্য ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা প্রথমেই সমস্ত বিদেশী সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছেন। পরে দুনিয়াব্যাপী প্রতিবাদের মুখে নিজেদের পছন্দ মতো বাছাই সাংবাদিকদের বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সে সঙ্গে বলে দেয়া হলোÑ অমুক অমুক জায়গায় যেতে পারবেন না। তমুক তমুক কথা লিখতে পারবেন না। অমান্য করলে হয় আটক, নয় লেখা গুম। এতসব বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও বিদেশী খবরের কাগজগুলো যা লিখছে তাতে জঙ্গী শাহীর প্রচারের বা অপপ্রচারের বেলুনটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। নিউজ উইক পত্রিকার কথায় ধরা যাক, এ সাপ্তাহিকটির সঙ্গে সাক্ষাতকারে ইয়াহিয়া খান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ অপরিহার্য বলেছিলেন। সে কাগজই লিখেছে, ইয়াহিয়ার সরকার যাদেরকে অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় চর বলছে তারা তো শুরু থেকে লড়ছে সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে। এরা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর লোকজন ছাড়া আর কিছুই নয়। পত্রিকাটিতে ভারতীয় গোলাবর্ষণের পাকিস্তানের অভিযোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শেলগুলো পরীক্ষা করলেই যে কোন পর্যবেক্ষক বুঝতে পারবেনÑ এগুলো নিকট পাল্লার কামান বা দু’ইঞ্চি মর্টার থেকে বর্ষিত হয়েছে। দূরত্ব বিচার করে একথা অনায়াসে বলা চলে, ভারত থেকে বর্ষণ করলে শেলগুলো এত দূরে আসতে পারে না। বিলেতের কাগজগুলো, বিবিসি, ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন সংবাদপত্র লামন্ড বলছে একই কথা। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? তোতার শেখানো লবজ তো পাল্টে যাবে না। এরপর ধরুন না, অবস্থা স্বাভাবিক, দেশপ্রেমিকরা দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিচ্ছে তোতার এ বাণীর কথা। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা জঙ্গীশাহীর সঙ্গে এমনই সহযোগিতা করছেন যে, এখন তাদের ওপর পিটুনি ট্যাক্স ধার্য করতে হচ্ছে জঙ্গীশাহীকে। এতেও যদি নিজেদের দৈন্য প্রকাশ না পায়, তবে দৈন্য শব্দের আভিধানিক অর্থই পাল্টে ফেলতে হবে। বিবিসির ভাষ্যকারের মতে, পিটুনি ট্যাক্স ধার্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক-জঙ্গী শাহীর দাবির অসারতা দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, মুক্তিবাহিনীর লোকজন বাংলার মানুষের যে অকুণ্ঠ সহযোগিতা পাচ্ছেÑ এতে কী তা সুস্পষ্ট বোঝা যায়? দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টেলিগ্রাফ ও বিবিসির মতে, বাংলাদেশের মাইলের পর মাইল এলাকায় ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বা তার ক্রীড়নক সরকারের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সর্বোপরি ইয়াহিয়ার চামচার দল রাতের বেলায় কোথাও বের হতে সাহস করে না। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে জঙ্গীশাহীর এই যখন হাল-হকিকত সৈন্য দলের মোর‌্যাল ঠিক রাখার জন্য ঠিক তখন খান সাহেবরা গোয়েবলসে প্রেতাত্মার ঘাড়ে ভর করেছেন। তাই প্রতিদিন কুৎসা আর মিথ্যার বোঝা তাদের বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেই দিন আর দূর নয়। যখন মিথ্যের বোঝায় চাপা পড়ে জঙ্গীশাহীকে পুঁজিপাট্টাসমেত পৈত্রিক প্রাণটাও হারাতে হবে। গোমর ফাঁক একেবারে গোমর ফাঁক। ইয়াহিয়া খানের জবর বাক্যবাগীশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজীকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে মার্কিন কাগজ নিউজ উইক। তিনি বলেছিলেন মার্চে যা করেছি, প্রয়োজনবোধে আবার তা করব ঢাকার রাজপথে। আমাদের ট্যাংকগুলো অপেক্ষা করছে। কিন্তু নিউজ উইকের সিনিয়র এডিটর আরনড দ্য ব্রচগ্রেভ তো আর নিয়াজীর ক্যান্টনমেন্টের সিপাই নন। সাফ বলে দিয়েছেন, জেনারেল তুমি মূর্খের স্বর্গে বাস করছ। পায়ের তলায় মাটি যে কতটা সরেগেছে তার তো খবর রাখ না। বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ থানার ওপর তোমাদের কোন কর্তৃত্ব নেই। মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। খোদ ঢাকার উত্তরাংশ এখন মুক্ত। বাংলাদেশে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে অভিযান শেষ করার লম্বা-চওড়া আশ্বাসদানকারী নরঘাতক জেনারেল টিক্কাখানের সুবৃহৎ বেলুনটি চুপষে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই এ.এ.কে নিয়াজীর আবির্ভাব। পাঞ্জাবের সাবেক সামরিক প্রশাসক ও এই জেনারেলের ভূমিকা সামরিক চক্রের জঘন্য ষড়যন্ত্রগুলোতে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ সারাদেশ গর্জে উঠেছিল আইয়ুবের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। হরতাল, মিছিল আর ঘেরাওয়ে প্রকম্পিত হয়েছিল সামন্তপ্রভু একচেটিয়া পুঁজিপতি আর সামরিক চক্রের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ। পশ্চিমা আমলারা আহার-নিন্দ্রা পরিত্যাগ করে ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছিল সামরিক অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে। সে সময়ে এ নিয়াজীকে দেখা যায় ঝিলামের একটি সামরিক ছাউনী এলাকায় অফিসারদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে, সংগঠিত করতে। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চের ইয়াহিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানের কাহিনী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ বলেছিল, জেনারেল নিয়াজীর (যাঁকে সামরিক চক্র টাইগার নিয়াজী বলে অভিহিত করে থাকে)। নেতৃত্বে একদল অফিসার এ মর্মে আল্টিমেটাম দিয়েছিল যে, তারা বাংলাদেশের তথাকথিত অরাজকতা কোন মতেই বরদাস্ত করতে রাজি নয়। তাদের মতে, এই সময়ে যা চলছে তাকে বাড়তে দিলে সব যাবে। পাঞ্জাবের ঝিলামের সেই কুখ্যাত বৈঠকে ঠিক করা হয়েছিল বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য। যদি দরকার হয় তবে লক্ষ লক্ষ লোককে সাবাড় করে দেয়া হবে। শহরে, নগরে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলের ওপর প্রয়োজনবোধে চালানো হবে ট্যাঙ্ক। তবে নিয়াজীর বড় আফসোস ছিল ১৯৬৯ সালেই এগুলো ঘটেনি বলে। অতএব নিয়াজী এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশের গণহত্যার ব্লু প্রিন্টটা দু’বছরের জন্য কোল্ড স্টোরেজে রেখে দিয়েছিল। তাই একাত্তর সালের মার্চের শুরুতেই বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের আলোতেই এসব জেনারেল তাদের বিপদের সংকেত দেখতে পায়। কায়েমি স্বার্থ বিপন্ন। তাই তারা চক্রান্তের জাল ফেলতে শুরু করল একে একে। অবশেষে এলো ২৫ মার্চের সেই কালো রাত। টিক্কা খানের সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল নিয়াজী বাংলাদেশে এলেও চলমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তার আগমন বার্তা ঘোষিত হয়নি। কিছুটা নেপথ্যেই রয়ে গেলেন তিনি। দায়িত্ব দেয়া হলো বাঙালী নিধনের অপারেশনের। তারপর একদিন রণাঙ্গণে তার আবির্ভাব সামরিক প্রশাসক ও ইস্টার্ন কমা-ের কমান্ডাররূপে। কিন্তু এবারে জেনারেল সাহেবের ইস্টার্ন কমান্ড একেবারেই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে মুক্তিবাহিনীর গোলা আর বুলেটের আঘাতে আঘাতে। অবস্থা বেগতিক দেখে একদল ক্ষুদে ডাকাত রাজাকার শাসক সৃষ্টি করা হলো যাদেরকে নিউজ উইক পত্রিকা ‘রাস্তার বখাটে তস্কর দল’ বলে অভিহিত করেছে। পত্রিকাটির মতে, অস্ত্র হাতে আছে বলে রাজাকারের দল নিজেদের খোদা বলে মনে করে। যত্রতত্র নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করছে। যারা তাদের আশ্রয় দিতে বা মেয়েলোক সরবরাহ করতে অস্বীকার করছে, তাদেরকে হত্যা করছে গুলি করে। এরপর মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অভিযানের সামনে সেনাবাহিনী প্রথমেই ঠেলে দিচ্ছে এসব নির্বোধ রাজাকারের দলকে। এসব সত্ত্বেও জেনারেল নিয়াজীর লম্বা-চওড়া দাবি কেন? নিউজ উইকের মতে, পরাজয়ের গ্লানি কিছুটা লাঘবের জন্য জেনারেলের জল্লাদ বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে ব্যাপক হারে, চালাচ্ছে লুটতরাজ। সংবাদদাতা ঢাকা ডেমরা এলাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যদল এ গ্রামটিও ঘেরাও করে বার থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের প্রত্যেক মহিলার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং বার বছরের ওপরে সকল পুরুষকে হত্যা করে। এ হত্যা, লুণ্ঠন ও পাশবিকতায়ও শেষ রক্ষা যে অসম্ভব দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর পদ্মা, মেঘনা, যমুনার উত্তাল তরঙ্গের দিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বুমেরাং ব্যাপারটি এমন বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনীর জবরদস্ত সেনাপতি ইয়াহিয়া খান সাহেবের তা কি ভাবতে পেরেছিলেন? দুধ-কলা দিয়ে পুষে যাকে চীনে পাঠানো হলো সেই কি না বলে ফোঁস? চীন কি আশ্বাস দিয়েছে না দিয়েছে সেটা বড় কথা নয়। চীন থেকে এসেই ভুট্টো চীনা হাজী বলে জাহির করতে আরম্ভ করে দিয়েছে নিজেকে। ভুট্টোর বাগাড়ম্বরে মদদ দিচ্ছে কয়েকজন ডাকসাইটে আমলা আর খোদ ইয়াহিয়ার জঙ্গী চক্রের ইনার সার্কেলের জনা দুই জেনারেল। আমলাদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের সাবেক ফরেন সেক্রেটারি এস.এম. ইউসুফ। তিনি পাকিস্তান স্টীল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। অপরজন হলেন ইয়াহিয়ার অর্থ উপদেষ্টা এম.এম আহমদ। এ দু’জন নাকি চীনে প্রেরিত প্রতিনিধি দলের নেতারা ভুট্টোকে দেয়া আশ্বাসের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দিয়েছিলেন। একেবারে শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর। আইয়ুবের আলো দশকে পর্বত প্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিতে কোন একটি আমলার ব্যক্তিগত অবদান যদি সর্বাধিক হয়ে থাকে তবে তার নাম নিঃসন্দেহে এম.এম আহমদ। এই দশ বছরে অর্থ দফতরের চাবিকাঠি কোন সময়ে ভদ্রলোকের হাতছাড়া হয়নি। তিনিও হতে দেননি। অর্থই অনর্থের মূল। তাই তিনি এটাকে নিয়েই নাড়াচাড়া করেছেন। ছিলেন কখনও অর্থ সেক্রেটারি, কোন সময়ে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান বা খোদ প্রেসিডেন্টের অর্থ উপদেষ্টা। তারই অধিনায়কত্বে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যারোমিটার একলাফে শুধু মাথায় উঠেনি, পাকিস্তানের কুখ্যাত বাইশ পরিবার দেশের ব্যাংক বীমা ও কারখানার শতকরা আশি ভাগ সম্পদ করায়ত্ত করতে সমর্থ হয়েছে। পাঞ্জাবের কায়েমী স্বার্থবাদী অর্থাৎ সামন্ত ভূস্বামীর গায়ে আঁচড়টিও লাগুক, এমন কিছু ভদ্রলোক হতে দেননি কোন সময়ে। অন্যদিকে, এককালের ফরেন সেক্রেটারি এস.এম. ইউসুফ বর্তমানে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করে আছেন যাকে লুটপাট ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। এ প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান স্টীল কর্পোরেশনের কাজ কারবার এমন এলাহী ব্যাপার যে, তার তুলনা মেলা সত্যিই অসম্ভব। করাচিতে একটি ইস্পাত কারখানা স্থাপনের ভার দেয়া হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রায় চৌদ্দ বছর আগে। এ কারখানা স্থাপনের সর্বমোট আনুমানিক যে খরচ ধরা হয়েছিল পাকিস্তানের কর্মকর্তারা চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা রিপোর্ট তৈরির আগেই তার চেয়ে বেশ কয়েক কোটি টাকা বেশি সাবাড় করে ফেলেন। এরমধ্যে বিদেশ থেকে পাওয়া ঋণ হিসেবে পনের কোটি টাকার বৈদেশিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। আর জনগণের এ পয়সা লুটপাটের প্রধান বখরা জুটেছে বাইশ পরিবারের লোকজনদের ভাগ্যে। এ দু’জন খ্যাতিমান আমলার সঙ্গে আরও একজন জেনারেল এসে দাঁড়িয়েছেন ভুট্টোর পেছনে। পাকিস্তান মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের প্রধান মেজর জেনারেল আকবর খান। ইসলামের গ্লোরি একটু নড়চড় হলেই জেনারেল সাহেব একেবারে অগ্নিশর্মা। এ জন্য তিনি মওদুদীর ইসলামী জামায়াতকে আকাশে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে মওদুদীর ইসলাম তার আর জামায়াত পশ্চিম পাকিস্তানে একেবারে ধরাশায়ী হওয়াতে তিনি প্রমাদ গুনলেন। ইসলামের গ্লোরি যায় যায়। কি উপায়? উপায় মিলেও গেল। ভুট্টোর টম টম মজুদই ছিল। উঠে বসলেন। শুরু হলো ইসলামাবাদের সামরিক গোয়েন্দা দফতরের সুরম্য প্রাসাদটিতে একের পর এক চক্রান্ত। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ভুট্টোর ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ গোছের ভাবসাব পছন্দ করতে পারছেন না পশ্চিম পাকিস্তানের আরও দু’জন জেনারেল গবর্নর। সিন্ধুর গবর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল রহমান গুল ও পাঞ্জাবের গবর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতিকুর রহমান। তারা নাকি ইয়াহিয়া খানকে বলেছেন, ভুট্টোর বুজরুকিতে বিশ্বাস করার কিছুই নেই, পিকিং তাকে খালি হাতে শুধু মিষ্টি কথায় ফেরত পাঠিয়েছে। সব মিলিয়ে পি-িতে এখন জেনারেলে জেনারেলে টক্কর লাগার মত অবস্থা। তাই ইয়াহিয়ার নাকি আহার-বিহার শিকেয় উঠেছে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে এক প্রখ্যাত সাংবাদিক ও পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার সাবেক সম্পাদক মাজহার আলী খান সম্প্রতি বলেছেন, ১৯৬৫ সালের আগে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানকে যত সৈন্য বা অফিসার হারাতে হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মারা পড়েছে মুক্তি বাহিনীর হাতে। পিআইয়ের বিমানগুলো প্রতিনিয়ত ঢাকা থেকে বয়ে এনেছে আহত অফিসার ও জোয়ানদের। জনাব খান কুয়েতের ডেইলি নিউজ পত্রিকায় লিখিত নিবন্ধে একথা জানিয়েছেন। তার মতে, সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব শুধু বড় শহরগুলোতে সীমাবদ্ধ। এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অরাজকতা। মাথাপিছু আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, এভাবে আর কতদিন চলতে পারে। যখন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে, সেনাবাহিনীর চাহিদা বাড়ছে দিনের পর দিন এবং বৈদেশিক সাহায্যের উৎসগুলো শুকিয়ে আসছে। জনাব খান বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বহু লোক এখন প্রকাশ্যে বলছেন, ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে যদি খারাপরূপে আখ্যায়িত করা হয়, তবে দু’জন জেনারেলের তেরো বছরের শাসনে দেশ এখন বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বলতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখন ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশকে (পূর্ব পাকিস্তান) জোর করে আর আটকে রাখা সম্ভব কী না। পশ্চিম পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যদি ইতিহাসের পাতা একবার উল্টে দেখেন, বাংলার মানুষের রক্তের অক্ষরে লেখা স্বাধীনতার দীপ্ত শপথের নতুন অধ্যায় সেখানে দেখতে পাবেন। ইয়াহিয়ার ভিক্ষার থলে ইয়াহিয়ার জঙ্গী সামরিক চক্র বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মোকাবিলায় নাজেহাল হয়ে পূর্বে আর পশ্চিমে ছোটাছুটি করছে ভিক্ষের থলে নিয়ে। ভিক্ষের এ থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু’ধরনের দালালও মজুদ রয়েছে। একদল ছুটছে পশ্চিমে নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন অভিমুখে, অন্যদল পা বাড়িয়েছে পিকিংয়ের পথে। ওয়াশিংটনে দেন-দরবার করছে দক্ষিণপন্থী পিডিবি, জামায়াতে ইসলাম আর মুসলিম লীগের নেতারা। আর পিকিং গেছে বামপন্থীর ভেকধারী ক্ষমতালোলুপ জুলফিকার আলী ভুট্টো। উদ্দেশ্য অবশ্য একটাই-বাংলায় গণহত্যার জন্য দু’হাতে রসদ, মাল-মসলা সংগ্রহ করা। পাকিস্তানের কূটনৈতিক ইতিহাসে অবশ্য এ দ্বিচারিণী নীতি রেশ কিছুকাল যাবত চলে আসছে। শুরু সেই ‘প্রভু নয় বন্ধু’র কুখ্যাত ফিল্ডমার্শাল আইয়ুবের আমল থেকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বনের পরোয়া তারা করেননি। সে কারণে সিয়াটো-সেন্টো ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বর্জনের প্রশ্ন নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। তাই তাদের দু’দিকে তাল দেয়া অসৎ পথে ফায়দা লোটার চেষ্টা মাত্র। এ জন্য দু’রকমের দালালকে তারা নিয়োগ করল। যখনই কোন সংশয় দেখা দেয়, তখন এরা ছোটে পূর্বে আর পশ্চিমে। পশ্চিমের দরজা এখন অবারিত। থলি পাতাই আছে। কিছু পাঠিয়ে দিলেই হল ঝুপ ঝুপ করে পড়তে থাকবে। ঢাকায় মস্তিষ্ক ধোলাই কারখানা অবজারভার হাউজের মূল গায়েন হামিদুল হক চৌধুরী পিডিপির নায়েব ছদর মি. শিরওয়ানী ওরফে মাহমুদ আলী প্রমুখের তৈল মর্দনের ফলে ওয়াশিংটনে মহাপ্রভুর পাইপ লাইন একেবারে সাফ সুতরো। যা চাইবে চলে আসবে পাইপ লাইনে। সিনেটর বা খবরওয়ালাদের ওজর আপত্তিতে কোন কাজ হবে না। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের পঁচানব্বই লক্ষাধিক শরণার্থীর দুঃখ দুর্দশার কথা যতই বলুন, সিনেটর ফুলব্রাইট সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য খসড়া প্রস্তাবই তুলুন না কেন, কিছু যায় আসে না। ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র পশ্চিমা কাউবয়দের জন্য দেশের গোচারণ ক্ষেত্রের চিরকালের জন্য লিজ দিতেও প্রস্তুত। শুধু ১৯৭১ সালেই নয়, আরও কয়েকবার প্রায় একই ধরনের ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জনসন আর আইয়ুব খানের আমলে। প্রথম চোটে চাকরি গেল ইনফরমেশন সেক্রেটারি কুদরুতুল্লাহ শেহাব আর ফরেন সেক্রেটারি এসকে দেহলভির। এদের অপরাধ তৈল মর্দন ঠিকমত হচ্ছিল না। দ্বিতীয়বারে ধরাশায়ী হলেন খোদ মিনিস্টার ভুট্টো সাহেব। আর তাঁর সঙ্গে ফরেন সেক্রেটারি আজিজ আহমদ। এভাবে পাকিস্তানের জঙ্গী চক্র মার্কিন বিরাগভাজন অফিসারদের সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দিয়ে প্রশাসনযন্ত্রকে শোধন করে ওয়াশিংটনের মহান প্রভুদের ভজনা করেছে। এবারের পঁচিশে মার্চের পর ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেলের দফতরটি বড় বেশি বেঁকে বসেছিল। একের পর এক রিপোর্ট পাঠাতে লাগল বাংলাদেশের গণহত্যার বিবরণ দিয়ে। ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড শরণাপন্ন হলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের। জরুরী তলব করল কনসাল জেনারেল আর্চাট ব্লাডকে। অন্যদিকে ঢাকার মস্তিষ্ক ধোলাই কারখানার সেই চৌধুরী সাহেব দৌড়ালেন নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটনের পথে ইয়াহিয়ার গোপন বার্তা নিয়ে। তবে এবার তৈল বা মবিলে বিশেষ ফল হল না। হবেই বা কী করে? লক্ষ-লক্ষ লোককে খুন করা হয়েছে। তাই ব্লাড সাহেবের উল্টোপাল্টা রিপোর্ট। দু’য়ে মিলে মার্কিন জনমত পুরোদস্তুর আগুন। তোমরা চাইলে একেবারে ভিটেমাটি থেকে শুরু করে তোমার কাউবয়দের জন্য গোচারণ ভূমি পর্যন্ত লিজ দিতে প্রস্তুত আছিÑ একথাও বলতে হল। তারপরেও মহাপ্রভুর প্রাত্যহিক পদসেবার জন্য নিউইয়র্কে একটি বঙ্গজ দালাল দি গ্রেটকে সব সময়ের জন্য মজুদ রাখা হয়েছে। এতসব করেই না পশ্চিমের পাইপ লাইন পরিষ্কার রাখা গেছে। কিন্তু এবারে গোলমাল লেগেছে পরে। সেই এপ্রিলের আশ্বাসবাণীর পর সেখানকার নেতারা একবারও রা করেননি বাংলাদেশের প্রশ্নে। আমরা এতবার বলেছি, ওরা আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু। বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়াবেন। আমাদের যা দরকার হবে দেবেন। এক কথায় বলতে গেলে প্রায় ওদের মুখপাত্রের মতই আমরা একে একে সবকথা বলেছি, তবুও কোন অভয়বাণী পরে আজও এল না। বরং উল্টোসিধা নানা কথা আমাদের কানে ভেসে আসছে। এই তো পিংপং খেলায় ওদের একজন সহকারী প্রধানমন্ত্রী আমাদের শত্রু দেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কথা এমনভাবে বললেন যে, সেটা যেন মরমে এসে বিঁধে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা অসহ্য অন্তর্জ্বালায় ভুগছি, এভাবে বেশিদিন চললে সত্যি-সত্যি পুড়তে হবে। এসব কিছু ফয়সালার জন্যই তো ভুট্টোকে পাঠিয়েছি ওদের দেশে। এ লোকটি তো ওদের বন্ধু বলেই পরিচিত। হ্যাঁ, ইয়াহিয়া খান ঠিকই ধরেছেন। ভুট্টো ছাড়া আর কেউ বামপন্থীর ভেক নিয়ে জল্লাদদের সাহায্য করার জন্য এভাবে এগিয়ে আসার সাহস করবে না। কারণ, ভুট্টো সাহেবের রাজনীতির সমগ্র জগতটা গড়ে উঠেছে এমনিভাবে। জুনাগড়ের এককালের প্রধানমন্ত্রী স্যার শাহ নেওয়াজ ভুট্টোর পুত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনীতিতে হাতেখড়ি মীর জাফরের বংশধর ইস্কান্দার মির্জার কাছে। মির্জাই তাকে নিয়ে এসেছিলেন মন্ত্রী করার জন্য। কিন্তু মির্জা আইয়ুবের কাছে আউট হওয়ার পর ভুট্টো হলেন আইয়ুবের মন্ত্রী। একটানা প্রায় দশ বছর মন্ত্রীগিরির পর আরেকদিন আইয়ুবই তাকে গর্দান ধরে বের করে দিয়েছিলেন। মন্ত্রীত্বের এ দশ বছরের একদিকে তিনি যেমন আইয়ুবী মহাকীর্তন করেছেন, অন্যদিকে তেমনি দ্বিচারি পররাষ্ট্রনীতিতে একটা মনোহারি পোশাক পরানোর কোশেস করেছেন। এজন্য তাকে একাধিকবার সরকারীভাবে বা গোপনে বেজিং সফর করতে হয়েছে। এমনকি আইয়ুবী আমলে এক সময় তাঁকে পুবের লোক বলে সাধারণের মধ্যে একটা ধারণা জন্মে যায়। কিন্তু অচিরাত ওটা মিথ্যে প্রমাণ হল। দেখা গেল আইয়ুব খান ভুট্টোকে গলাধাক্কা দিলেও চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোন হেরফের হয়নি। ভুট্টোও এজন্য চীনাদের পথে বসাতে ছাড়েননি। বিগত সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির সাফল্যের পর তিনি মার্কিন সাংবাদিকদের তার লারকানার সুরম্য প্রাসাদে ডেকে নিয়ে বলেন, একমাত্র আমিই পারি পাকিস্তানে কমিউনিজম ঠেকাতে। মার্কিনীরা যেন এটা ভুলে না যায়। মার্কিনীদের এটা ভুলে যাওয়ার সঙ্গত কোন কারণও নেই। তাই তাদের আদমি ইয়াহিয়া এবার পিকিং-এ দরবার করার জন্য বামপন্থীর ভেকধারী ক্ষমতালোলুপ ভুট্টোকে পিকিং পাঠিয়েছে। যা করে হোক পিকিংয়ে একটা কিছু করতে হবে। তা না হলে ক্ষমতা কিন্তু পাবে না। কিন্তু ক্ষমতা ভুট্টো সাহেবের পাওয়া তো দূরের কথা, খোদ ইয়াহিয়া খান রাখতে পারেন কি-না তারই ঠিক নেই। একে তো বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার আক্রমণ, তরপর বেলুচ আর পাঠান মুল্লুকের অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। তারা পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলেছে। লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার পি-ির সংবাদদাতা কলিন স্মিথ এ খবর দিয়েছিল। তিনি বলেছেন, খাইবার গিরিপথ অঞ্চলের উপজাতীয় এলাকার বিশ হাজার লোক গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। শীঘ্রই তারা নাকি পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারে। অতএব, ইয়াহিয়া খান সাহেব, ভিক্ষার জন্য আপনি পূর্বেই হাত বাড়ান আর পশ্চিমে হাত বাড়ান, আপনার দু’হাতই এখন কাটা পড়ার উপক্রম হয়েছে। ভুট্টো মাহমুদ আলী, হামিদুল হক, নুরুল আমিন, মওদুদী, কাইয়ুম খা এরা কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে এতসব করেও বোধহয় শেষ রক্ষা হল না। হাড্ডির টুকরো প্রায় ফসকে যায় আরকি। তলোয়ার আলী ভুট্টো ওরফে জুলফিকার আলী ভুট্টোর আশার ফানুস উড়িয়ে যেভাবে পিকিং গিয়েছিলেন তা চুপসে গেছে। ইসলামাবাদেও উল্লাসের পরিবর্তে নৈরাশ্যের ছায়া নেমে এসেছে। ভুট্টো সাহেব পিকিংয়ে বিশেষ পাত্তা পাননি। তিনি পি-ি ফিরে যতই গলাবাজি করুন আলোচনা সফল হয়েছে, ইয়াহিয়া খান একই মুখে দু’রকমের কথা যতই বলুনÑ প্রথম দফায় চীন হস্তক্ষেপ ছাড়া অন্য সব সাহায্য দেবে। দ্বিতীয় দফায় চীন হস্তক্ষেপ করবে বলুন না কেন, দুনিয়ার মানুষের কাছে আজ এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, পিকিংয়ের শরণাপন্ন হয়েও তলোয়ার আলী সাহেব এমন কিছু আনতে পারেননি, যাতে ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকরা পুলকিত হতে পারেন। লন্ডনের দি টাইমস ও বিবিসির মতে, পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের চীন সফর শেষে কোন যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ না হওয়া থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায়, চীন পুরোপুরি পাকিস্তানী অভিমতের সঙ্গে একমত হতে পারছে না। এ অভিমতের পক্ষে একাধিক যুক্তি পেশ করা হয়েছে। (১) চীন-পাকিস্তান আলোচনা শেষে কোন যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়নি। চীন যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও এ উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে একমতই হবে তবে যুক্ত বিবৃতিতে না করার পেছনে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। যুক্ত বিবৃতি প্রচার করা হলে পাকিস্তান অন্তত সুখী হত। (২) এখন এটা পরিষ্কার ইসলামাবাদের অনুরোধেই পাক প্রতিনিধি দলের পিকিং যাত্রা স্থির হয়। পিকিং পাকিস্তানকে কোন আমন্ত্রণ জানায়নি। (৩) বাংলাদেশের গণহত্যা ও মুক্তি সংগ্রামকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে পরিণত করার জন্য ইসলামাবাদ কয়েকমাস ধরে এ উপমহাদেশের পরিস্থিতি রাষ্ট্রসংঘে তোলার চেষ্টা করে আসছে। তাই চীন-পাকিস্তান মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দাবি করেও ভুট্টো সাহেবকে বলতে হয়েছে, রাষ্ট্রপুঞ্জে বিষয়টি নিয়ে গিয়ে কোন লাভ হবে না। সব চাইতে বেকায়দায় পড়েছেন তিনি অস্থায়ী চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. চেং পেং এর বাংলাদেশ সম্পর্কিত বক্তব্যটি নিয়ে। তিনি পাকিস্তানকে বাংলাদেশ সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধান করতে বলেছেন। অন্যদিকে, চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পিকিংয়ের ভোজসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশ সমস্যা বা পাক-ভারত সম্পর্ক কোন কিছুরই উল্লেখ করেননি। চৌ-এর সম্মানে ভুট্টো সাহেব এ ভোজের আয়োজন করেছিলেন। ভুট্টো সাহেবের বোঝা উচিত ছিল, এটা ১৯৭১ সাল, ১৯৬৫ নয়। এ কয়বছরে ইয়াংসীর উত্তাল তরঙ্গমালায় অনেক সূর্য জ্বলেছে-নিভেছে। আসলে ভুট্টো এ্যান্ড কোম্পানি অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি শঙ্কিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তাই তিনি বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে আনতে হবে অবস্থা স্বাভাবিক হোক আর নাই হোক। এ জন্য তিনি ১০৭ পাতার একটি বইও লিখে ফেলেছেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে পিপলস পার্টি ভুট্টোর ‘ দি গ্রেট ট্রাজেডি’ নামের এ বইটি প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম তথা গেরিলা যুদ্ধের ব্যাপারে ভুট্টো সাহেব এতই শঙ্কিত যে তিনি জল্লাদ বাহিনীকে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ পরিহার করার নসিহত দিয়েছেন তার বইয়ে। তা না হলেই মুসিবত। বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) আরও সৈন্য আমদানি করতে হবে এবং এর কোন পরিসমাপ্তি নেই। ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাংক অনির্দিষ্টকাল ধরে ব্যবহার করা যাবে না। কেন ভুট্টো সাহেব, আপনার প্রভু ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর মনোবল কি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে, নাকি ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাংকে উঠতে পারছেন না এর জবাব অবশ্যই তার বই থেকে পাওয়া যাবে। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাহারা দিতে পারে না বা প্রতিটি নাগরিকের পেছনে একজন করে সৈন্য মোতায়েনও সম্ভব নয়। আরও আছে, বাংলাদেশের বিরাট জনসংখ্যা, সমতল ভূমি ও বিক্ষুব্ধ জনসমষ্টি গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র। তাই তিনি জল্লাদ বাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, যদি দেরি করে ফেলো তবে গেরিলাযুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এটা যাতে না ঘটতে পারে সেজন্য তো আপনি কম কোশেস করেননি ভুট্টো সাহেব। বাংলার মানুষ আপনার প্রভুর নির্দেশমতো কাঠামোর মধ্য থেকে সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন এবং নির্বাচিত করেছিল আওয়ামী লীগকে। বাংলার মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এ ধরনের প্রকাশ্য অভিব্যক্তি আপনি বরদাস্ত করতে পারেননি। তাই তো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যাতে না বসতে পারে তার জন্য আপনি আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন। হুমকি দিয়েছিলেন এ অধিবেশনে যোগদানকারী পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের ধরাপৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলার। তাই শুধু নয়, মার্চের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আকুল আবেদন আপনি কিভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন তাও দেশবাসীর অজানা নয়। আপনি নিজেই বলেছেন, ‘ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার পর বেরিয়ে যাওয়ার মুখে মিলিটারি সেক্রেটারির কক্ষে ঢুকতেই শেখ মুজিব আমার হাত ধরে পাশে বসালেন এবং বললেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর এবং এ সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার সাহায্য চাই। সঙ্কট সমাধানে তার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে শেখ আমাকে সেনাবাহিনী সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বললেন। তিনি বললেন, ‘সেনাবাহিনী যদি আমাকে হত্যা করে তবে তোমাকেও তারা ছাড়বে না’। বঙ্গবন্ধুর এই সৎ পরামর্শ আপনি গ্রাহ্য করেননি। একটি জাতিকে জঘন্যতম গণহত্যা থেকে বাঁচানোর আকুল আবেদনে সাড়া দেননি। দেবেনই বা কি করে। আপনি তো আগে থেকে গাঁটছড়া বেঁধে রেখেছিলেন টিক্কা ওমর আকবর গুল হাসান পীরজাদা হামিদ প্রমুখ জেনারেল চক্রের সঙ্গে। বাংলার মানুষের দাবি মেনে নেয়ার চেয়ে তাই তো আপনি সেনাবাহিনীর পক্ষ গ্রহণ শ্রেয় বলে মনে করেছেন। এজন্য নির্লজ্জের মতো বলতে পেরেছেন, রাত সাড়ে দশটার দিকে নৈশভোজ শেষ করে আমরা কক্ষে ফিরে এলাম। কয়েকজন বন্ধুও আমার রুমে এলেন। ঘণ্টাখানেক পর কামানের গোলার আওয়াজ আমরা শুনতে পেলাম। হোটেলের কক্ষ থেকে তিন ঘণ্টা ধরে সেনাবাহিনীর অপারেশন দেখলাম। একটার পর একটা বাড়ি জ্বলছে। ইংরেজী সংবাদপত্র ‘দি পিপলস’ অফিস ধ্বংস করতে দেখলাম। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ লাল হয়ে গেল, চারদিকে ধ্বংস আর মৃত্যুর বিভীষিকা, আশ্চর্য ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী এ বীভৎস হত্যালীলা আপনি শুধু নীরবে অবলোকন করলেন! কই, আপনার প্রভুর কাছে এর প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র সাহস আপনার হলো না। আপনি বলেছেন, ইতিহাসের কাছে মার খাওয়ার চেয়ে সেনাবাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণকে শ্রেয় বলে মনে করেন। কিন্তু ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবে না। দুনিয়ার একটি নৃশংসতম গণহত্যার দোসর হিসেবে ইতিহাস আপনাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। নয়া দাওয়াই ইয়াহিয়া খানের অতি সাধের পিতলের কলসিটি তৈরি হওয়ার আগেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। অতি সঙ্গোপনে একদল আমলা বিশেষজ্ঞ দিয়ে একেবারে রেডি করে জাতীয় পরিষদ নামক একটি জি হুজুরদের সংস্থার কাছে পেশ করা হবে বলে ফরমান জারি করা হয়েছিল। কাকপক্ষীতে না জানলে কি হবে, ফেউরা তার কিছু কিছু ফাঁস করে দিতে শুরু করেছে। জবরদস্ত জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খানের নিজের তত্ত্বাবধানে বিশুদ্ধ আমলা দ্বারা প্রস্তুত। খাঁটি প্রমাণে হাজার টাকা ইনাম। ডিরেক্টরের ছুড়ে দেয়া ‘গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রটি’ আসলে সে কি চিজ হবে সামরিক চক্রের এক নম্বর ফেউ নুরুল আমিন তা ইতোমধ্যেই ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, শাসনতন্ত্র নামক এই বস্তুটিতে সাম্প্রদায়িক নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকবে। ইসলামী জঙ্গী জোশে উন্মুক্ত ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী আর তার সরকারের কাছ থেকে এর চেয়ে আর বেশি কিছু আশা করা যায়? বাংলাদেশের মানুষ এতে বিস্মিত না হলেও ইয়াহিয়ার মহাপ্রভুরা নিশ্চয়ই কিছুটা আশ্চর্যই হবেন। কারণ তাদের দেশের পত্রিকাগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতকারে জল্লাদ দলের এ সরদারটি দু’দিন আগেও বাংলার মানুষের হতাশা পুষিয়ে দেয়ার বড় বড় কথা বলেছিল। মহাপ্রভুর দেশের সাধারণ মানুষ অবশ্য জানেন, ওই বড় বড় বুলি ফরেন কনজামশনের জন্য, ইমেজ ঠিক রাখার জন্য। তাই ফরেন ইমেজ সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত খোলসটি খসে পড়তেই পি-ির গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলো বের হয়ে পড়েছে। আর সোনার পিতলের কলসিটির মধ্য ??
×