ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে বিজয় পতাকা উড়েছিলো ১৯৭১ এর ৮ ডিসেম্বর

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

বরিশালে বিজয় পতাকা উড়েছিলো ১৯৭১ এর ৮ ডিসেম্বর

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বরিশাল নগরীর কালিবাড়ী রোড এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান কাঞ্চন। এজন্য তার দুই ছেলেকে নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে পাক সেনাদের ক্যাম্পের টর্চার সেলে আটক করে স্থানীয় রাজাকাররা কাঞ্চনকে আত্মসর্মপনের জন্য মাইকিং করেছিলো। দুই পুত্রের জীবন বাঁচাতে মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন পাক সেনাদের কাছে আত্মসমর্পন করার পর তার দুই পুত্রের সামনে বসেই দিনভর অমানুষিক নির্যাতনের পর তাকে (কাঞ্চনকে) ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। সেইদিনের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ননা করতে গিয়ে আজও আতঁকে ওঠেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান কাঞ্চনের পুত্র কামাল হোসেন (৫৮)। বলেন, বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় পাক সেনাদের সাথে নিয়ে স্থানীয় আলবদর, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা আমাকে ও ভাই জামাল হোসেনকে ধরে নিয়ে টর্চার সেলে আটক করে রাখে। পরবর্তীতে মাইকিং করে বাবাকে (মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন) আত্মসমর্পন করতে বলা হয়। আমাদের দুই ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে বাবা আত্মসমর্পন করেছিলেন। পাক সেনারা আমাদের দুই ভাইয়ের সামনে বসে দিনভর বাবাকে অমানুষিক নির্যাতনের পর ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে লাশ পাশ্ববর্তী ডোবায় ফেলে দেয়। পরবর্তীতে আমাদের দুই ভাইকে বেদম মারধরের পর ছেড়ে দেয়া হয়। সূত্রমতে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাক বাহিনী আকাশ পথে বরিশালে প্রথম হামলা চালায়। জল, স্থল ও আকাশ পথে ২৭ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় হামলা চালানো হয়। বরিশাল শত্রু কবলিত হওয়ার আগেই সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো স্বাধীন বাংলা সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সবাইকে নিয়ে এ সচিবালয় গঠিত হয়েছিলো। এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে এ সচিবালায় থেকে ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হতো। এ সচিবালায়ের সামরিক প্রধান ছিলেন মেজর এম.এ জলিল আর বেসামরিক প্রধান ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জু। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ৮ ডিসেম্বর দুপুরে পাক সেনারা গানবোট, লঞ্চ, স্টীমারে বরিশাল থেকে গোপনে পালিয়ে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে ওইদিন বিকেল তিনটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা চারিদিক থেকে পুরো শহরের নিয়ন্ত্রন নিয়ে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। বিজয়ের উল্লাসে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে নগরীর আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতিক বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত তথাকথিত পাকিস্তানের জাতীয় শান্তি কমিটির প্রভাবশালী ১০৪ জন সদস্যের মধ্যে বরিশালের ছিলো ৩১ জন। এই ৩১জন সদস্যকে নিয়েই ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল বরিশালে প্রথম গঠিত হয় তথাকথিত স্বাধীনতা বিরোধী জেলা শান্তি কমিটি। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা শান্তি কমিটির সহযোগীতায় বরিশাল শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে ক্যাম্প বসিয়ে টর্চারসেল স্থাপন করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান কাঞ্চন ও এ্যাডভোকেট সুধীর চক্রবর্তীর মতো অনেক মুক্তিকামীদের ধরে এনে এখানে ব্র্যাশফায়ার করে হত্যা করে পাশ্ববর্তী ডোবায় লাশ ফেলা হতো। সেইদিনের গণহত্যার নিরব স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকার শত বছরের বট বৃক্ষটি। মুক্তিকামীদের লাশ ফেলা সেই ডোবায় (বধ্যভূমিতে) সরকারীভাবে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। নগরীর কালিবাড়ী রোডের ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও নার্সিং সেন্টারের পাশের অরক্ষিত স্থান উন্নয়নের মাধ্যমে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান কাঞ্চনের নামে ২০০৯ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন উদ্যান” গড়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। কীর্তনখোলার তীরে নগরীর ৩০ গোডাউন সংলগ্ন বধ্যভূমিতেও নির্মিত হয় স্মৃতিফলক। ২০০৭ সালে নগরীর আমতলা মোড়ে নির্মান করা হয়েছে বিজয় বিহঙ্গ নামে আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ।
×