ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে আশার আলো

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে আশার আলো

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ সরকারী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা তৃণমুল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার সর্বনিম্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। এটি তৃণমুল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে কাছের সরকারী প্রতিষ্ঠান। ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত তথ্য ও প্রযুক্তিভিত্তিক কেন্দ্র ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার পরিষদকে আরও উন্নত এবং আধুনিক করেছে। তৃণমূল পর্যায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মাঝে সরকারী, বাণিজ্যিক ও তথ্যসেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত ও সহজলভ্য করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) একটি সম্ভাবনাময়ী উদ্যোগ। ইউডিসির মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে জমির পর্চা উত্তোলনের আবেদন, প্রবাসী শ্রমিক নিবন্ধন, হজ নিবন্ধন, পাসপোর্টের আবেদন, অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুর হিসাব, জন্মসনদ বিতরণসহ বিভিন্ন সরকারী তথ্যভিত্তিক সেবা পেতে অর্থ ব্যয়, সেবার জন্য গমন সংখ্যা ও সময় হ্রাসের সুযোগ তৈরি হয়েছে। রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের তৃণমূলের অগ্রনায়ক বর্তমান সরকারের ব্রেইন চাইল্ড খ্যাত ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সাথে কথা বলে ও সরেজমিন পরিদর্শন করে টিআইবির এক গবেষনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ইউডিসিগুলোতে উল্লে¬খযোগ্যসংখ্যক যন্ত্রপাতি অচল, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা ও ইন্টারনেটের ধীরগতি সত্ত্বেও এসব সেন্টারগুলো উল্লে¬খযোগ্যসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে দেশে ইউডিসি কার্যক্রম অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সেবা খাতে দুর্নীতি হ্রাস করতে ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে মানসম্মত সেবা ব্যাহত হচ্ছে। অধিকাংশ ইউডিসিতে মোডেমের মাধ্যমে সংযোগ থাকায় ইন্টারনেটে ধীরগতি। ফলে অনলাইন সেবা বিলম্বিত হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততার কারণে ও ইন্টারনেটে ধীরগতি থাকায় যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সেবা গ্রহীতাদের সেবা দিতে ইউডিসির উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘নাগরিক সেবায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার : ভূমিকা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াটা বেশ কয়েক বছর আগে থেকে নেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও খুব বেশি তা বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভূমিখাতে যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন তারা লাভবান হচ্ছে। গবেষণায় পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিজিটালাইজেশন করতে পারলে মানুষ প্রতারণা বা হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে। সেবাখাতগুলো যত দ্রুত ডিজিটালাইজেশন হবে, ততো বেশি মানুষ অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে মুক্তি পাবে। সংশ্লি¬ষ্ট গবেষক দলের অন্যতম সদস্য টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি জানান, ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের জেলা পর্যায়ের ভূমি রেকর্ড রুমে আর্থিক অনিয়ম হয়। সেখানে জমির পর্চা তুলতে ৫৬ শতাংশ সেবা গ্রহীতাকে গড়ে ৭৩৭ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। তবে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) একটি ব্যাপক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানে সেবা গ্রহীতাদের একই সেবা পেতে কোন আর্থিক অনিয়মের শিকার হতে হয়না। গবেষক দল স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে ইউডিসি পরিচালনা ও ব্যবস্থানার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে ১১ দফা সুপারিশ পেশ করেন। ইউডিসির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় টিআইবির পক্ষ থেকে উত্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হলো-ইউডিসির উদ্যোক্তাদের নির্বাচন ও তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, চুক্তির মেয়াদ, মুনাফা বন্টন, সেবামূল্য, ইউপি থেকে সহায়তা পাওয়ার শর্তাবলি, তথ্য সংরক্ষণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে অংশীজনদের জন্য নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন। টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান জানান, জমির পর্চা তুলতে আবেদনের ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের সেবা গ্রহীতাদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশকে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। আর থাকা, খাওয়া ও যাতায়াত বাবদ গড়ে ৪৪৯ টাকা ব্যয় করে তিনবার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে যেতে হয়েছে। এছাড়া ৫৬ শতাংশ সেবা গ্রহীতাকে গড়ে ৭৩৭ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। অন্যদিকে ইউডিসি থেকে জমির পর্চা আবেদনের ক্ষেত্রে এক থেকে দুই ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। থাকা, খাওয়া ও যাতায়াত বাবদ কোন টাকা খরচ করতে হয়নি এবং দুইবার ইউডিসিতে যেতে হয়েছে। এছাড়া জরিপভুক্ত সেবা গ্রহীতাদের কেউ আর্থিক অনিয়ম, ঘুষ বা আর্থিক লেনদেনের শিকার হননি। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার উদ্যোক্তা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাহতাব আলী জানান, রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের তৃণমূলের অগ্রনায়ক বর্তমান সরকারের ব্রেইন চাইল্ডখ্যাত ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন থেকে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম প্রচারনার পাশাপাশি নিরলস ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে নানামুখী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের (উদ্যোক্তা) কাজের গতি আরও বৃদ্ধির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে উদ্যোক্তাদের সরাসরি নিয়োগের কোন বিকল্প নেই। সূত্রমতে, ইউনিয়ন পরিষদকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয় থেকে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর এবং নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি)’র প্রশাসক মিস হেলেন ক্লার্ক ভোলার চর কুকরিমুকরি ইউনিয়ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারাদেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করেন। যা বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) নামে পরিচিত। এই সেন্টারের মুল লক্ষ্য হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। যাতে করে দেশের সাধারণ মানুষ এ সেন্টার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সেবা পেতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়। এই সেন্টার যাতে করে ২০২১ সালের মধ্যে একটি তথ্য ও জ্ঞান ভিত্তিক দেশ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সূত্রে আরও জানা গেছে, ইউডিসি প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি অবাধ তথ্য প্রবাহ সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয়েছে। বর্তমানে মানুষকে আর সেবার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছেনা, বরং সেবাই পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের ফলে সাধারণ লোকজন এখন অতি সহজে সরকারী ও বেসরকারী ঝামেলাহীনভাবে প্রায় ৬০ রকমের সুবিধা ভোগ করছেন। এই সেন্টারের উল্লেখযোগ্য সরকারী সেবাসমূহগুলো হলো, অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, জীবন বীমা, নাগরিক সনদ, নাগরিক আবেদন, ভিজিএফ-ভিজিডি তালিকা, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, জমির পর্চা, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, সরকারী ফরম ইত্যাদি। বেসরকারী সেবাসমূহ হলো, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-মেইল, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, চাকরির তথ্য, কম্পোজ, ভিসা আবেদন, ফটোকপি, স্ক্যানিং, লেমিনিটিং ইত্যাদি। এছাড়া কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এ সেন্টারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়পযোগী এ পদক্ষেপের জন্য সারাদেশের মানুষ আজ তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আগে যেখানে দেশের মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুর হিসেব রাখা সম্ভব ছিলনা, ইউডিসির কারণে এখন তা সম্ভব হয়েছে। ইউডিসি কেন্দ্রের দায়িত্বরত উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার কারণে পরিষদের প্রতি সাধারণ মানুুষের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের প্রতিটি ইউডিসি কেন্দ্র দিনের বেশির ভাগ সময় খোলা থাকে। যার কারণে সাধারণ মানুষ যেকোনো সময় তাদের কাজ করে নিয়ে যেতে পারছেন। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের ফলে একদিকে যেমন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়েছে তেমনি দেশের অসংখ্য শিক্ষিত বেকার ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য যা একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
×