ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কর্ণফুলীতে দুগ্ধ খামারি নাজিমের বিপ্লব

এক মুরগি থেকে শতাধিক গরু

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৮ নভেম্বর ২০১৭

এক মুরগি থেকে শতাধিক গরু

জীবনের প্রথম উর্পাজন মাত্র ৩০ টাকা। এ টাকা থেকেই কোটিপতি হয়েছেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার দুগ্ধ খামারী নাজিম উদ্দিন হায়দার। বর্তমানে তিনি কয়েক কোটি টাকার মালিক। এটি কোন কাল্পনিক ঘটনা নয়। বাস্তবে পোল্ট্রি ও দুগ্ধ খামার শিল্প করে তিনি যেমন কোটিপতি হয়েছেন তেমনি প্রান্তিক কৃষকের মুখে হাসি ফুটাতে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। তার থেকে উৎসাহ পেয়ে কর্ণফুলী ও পার্শ্ববর্তী পটিয়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে ৫ শতাধিক ছোট বড় দুগ্ধ খামার। এসব খামার থেকে হাজার হাজার লিটার দুধ চট্টগ্রাম পেরিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছে। খামারী নাজিমের প্রচেষ্টায় এলাকায় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) পশ্চিম পটিয়ার দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র। এখান থেকে দুধ শীতল করে মিল্কভিটার ঢাকাস্থ পূর্ণাঙ্গ কারখানায় নিয়ে প্রক্রিয়া ও প্যাকেটজাত করে তা পুনরায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত করা হয়। নাজিম উদ্দিন হায়দার ১৯৭৬ সালের ৪ নবেম্বর পটিয়া উপজেলার (বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলা) কর্ণফুলী থানাধীন উত্তর চরলক্ষ্যা গ্রামের ৩নং ওয়ার্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাস্টার রশীদ আহমদ ও মাতার নাম সাহেরা বেগম। তারা ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে নাজিম তৃতীয়। কিশোর জীবন থেকে শুরু করে নাজিমের প্রতিভা প্রতিটি কাজে সাফল্য এনেছে। ১৯৯১ সালে জীবনের প্রথম উপার্জন ৩০ টাকা। এ টাকা দিয়েই দেশীয় ১টি মুরগি কিনে তা লালন পালন করে বাচ্চাসহ মুরগি ৪শ’ টাকায় বিক্রি করে। নিজের ৪০০ টাকা, বাবা থেকে ১০০ টাকা, নানি থেকে ১০০ টাকাসহ মোট ৬শ’ টাকা যোগাড় করে ১৯৯২ সালে একটি ছাগল পালন শুরু করে। যা কিছুদিন পর ৩ হাজার ৩শ’ টাকায় বিক্রয় করেন। ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে একটি ষাড় বাছুর কিনেন। যা বর্গা দেন এবং পরবর্তীতে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রী করলে নাজিম ২৩ হাজার ৩৩৩ টাকা পান। ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে নিজের ৩০ হাজার টাকা ও চাচাতো ভাই আবছারের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে প্রথমে ৩শ বয়লার মুরগিসহ পোল্ট্রি খামার শুরু করে। যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রবীণ এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুপ্রেরণায় সানোয়ারা ডেইরী ফার্মের মুরগির পরিবেশক হিসেবে নাজিম নিয়োগ পান। এর পর থেকে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে পোল্ট্রি শিল্পের উৎসাহ উদ্দীপনায় বাড়তে থাকে এবং জমজমাট হয়ে ওঠে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসা। ১৯৯৬ সালে সানোয়ারা ডেইরি ফার্মের গরুর খামার পরিদর্শনে গেলে নাজিম দুগ্ধ খামার করার স্বপ্ন দেখেন। এরপর সানোয়ারা ডেইরী ফার্ম থেকে ৪৪ হাজার টাকায় একটি ফ্রিসিয়ান জাতের শংকর গাভী ক্রয় করেন। পাশাপাশি ব্রয়লার বাচ্চার নতুন ব্যাচ লালন পালন শুরু করে। এক পর্যায়ে ২০১০ সালে বার্ড ফ্লু রোগে মুরগি আক্রান্ত হলে নাজিমের কয়েক হাজার মুরগি মারা যায়। এতে বিভিন্নভাবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে তার খামারে ১০৭টি দুগ্ধ গাভী, ৪টি মহিষ, ৪টি ভেড়া, ৪টি উন্নতজাতের ছাগল ছাড়াও ১ হাজার বয়লার মুরগির আলাদা ফার্ম রয়েছে। প্রতিদিন তার খামার থেকে ৫শ’ লিটার দুধ মিল্ক ভিটার কারখানায় যাচ্ছে। তাছাড়া গরুর খামারের বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করে ৩৫ পরিবারের মাঝে বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করে যাচ্ছে। নাজিম উদ্দিন হায়দার বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় লিমিটেডে (মিল্ক ভিটা) ২০১৫ সালে প্রথম পরিচালক নির্বাচিত হয়। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি পুনরায় চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। এ পর্যন্ত নাজিম মিল্ক ভিটার তিনবার শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছেন। খামার শুরু করার সময় পশ্চিম পটিয়ার ডেইরী এ্যাসোসিয়েশন গড়ে সদস্য হন। পরবর্তীতে খামারীদের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি (নাজিম) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সংগঠনের উদ্যোগে খামারীদের কল্যাণে তিনি বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামেও ভূমিকা রেখেছেন। দুধের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ জানান। যা সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়। নাজিমের একান্ত প্রচেষ্টায় এলাকায় দুুগ্ধ শীতল কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। যার পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা ছিল সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের। বর্তমানে পশ্চিম পটিয়া-কর্ণফুলী এলাকায় মিল্ক ভিটার পূর্ণাঙ্গ কারখানা বাস্তবায়নাধীন। ২০১৩ সালে বিএনপি ও জাতায়াতের ডাকা হরতাল অবরোধ চলাকালে মিল্ক ভিটার দুধের গাড়ি পটিয়া থেকে ঢাকায় যেতে না পারার কারণে নাজিমের নেতৃত্বে খামারীরা ডোবায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ জানালে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, পটিয়ার সাংসদ সামশুল হক চৌধুরীকে স্মারকলিপির মাধ্যমে খামারীদের বিষয়টি অবগত করান। পরবর্তীতে পুলিশ প্রশাসনের পটোকলে পটিয়া মিল্ক ভিটা থেকে ঢাকা মিরপুর মিল্ক ভিটার কারখানায় দুধ পাঠানো হতো। নাজিমের এক ছেলে এক কন্যা সন্তান রয়েছে। -বিকাশ চৌধুরী, পটিয়া থেকে
×