ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মাটির গানে সুবাসিত ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১৭’

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

মাটির গানে সুবাসিত ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১৭’

গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনা-আনন্দ-বিরহ-প্রেম-অভিমান-বন্দনা, সব মানবিক অনুভূতিকে গানের সুরে ও কথায় প্রকাশ করে লোকসঙ্গীত। এই সঙ্গীতই হচ্ছে যে কোন দেশের সংস্কৃতির মূল স্তম্ভ, যা কিনা ছড়িয়ে থাকে শেকড়ের গভীরে। যার আবেদন থাকে সব সময়ই। বাউল, বৈষ্ণব এবং সাধকের সুরে-পরশে মোড়া গান সবসময়ই আমাদের কাঁদায়-হাসায়-ভাবায়। শিকড় সন্ধানীরা তাই স্বীকার করেন এ শুধু গান নয়, সুরের মায়াজালে বন্দী এক জীবনদর্শন। এর অপূর্ব সুর আর কথায় পরিশুদ্ধ হয় আত্মা। যে কারণে লোকজ ও শিকড়ের গান সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে একেকটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তাদের এই কথার সত্যতা প্রমাণ করতে ও মাটির গানের সুবাস ছড়িয়ে দিতে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১৭’। গত ৯ থেকে ১১ নবেম্বর পর্যন্ত ৩ দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোকফেস্ট ২০১৭। বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত চলেছে এই অনুষ্ঠান। হাজার হাজার মানুষের পদচারনায় মুখরিত হয়েছে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ। অনুষ্ঠান উদ্বোধনের দিন প্রথমে মঞ্চে ওঠে বাংলাদেশের তরুণ লোকগানের দল বাউলিয়ানা প্রথমেই ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’, ‘বাউলা কে বানাইল রে’। এ গান গেয়ে শোনায় পরে মঞ্চে ওঠেন শাহ আবদুল করিমের সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় কাটানো ফকির শাহাবুদ্দিন তিনি গান ‘দিনও বন্ধু’ গানটি নিয়ে। একে একে তিনি গেয়ে শোনান ‘তুই যদি হইতি গলার মালা’, ‘বন্দে মায়া লাগাইসে’, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এবং একটি ভা-ারি গান। তার পরে মাউরিসিও টিযুম্বা। টিযুম্বার পরিবেশনের পরপরই শুরু“হয় উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। এর পর মঞ্চে ওঠেন তিব্বতের নেজিন চেওগাল ও ভারতের সঙ্গীতশিল্পী পাপন। বলে রাখা ভাল ফকির শাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত, বাউল ও সুফি গানের অন্যতম শিল্পী। পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকার হিসেবেও সুপরিচিতি অর্জন করেছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাউল সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত তিনি। লোকগানের কিংবদন্তি শাহ আবদুল করিমের সান্নিধ্যে আসার পর বাউল গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি একজন বাউল গানের সংগ্রাহকও। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত, যুক্তরাজ্য, দুবাই, আলজেরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে গিয়েও সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন তিনি। টেলিভিশন এবং বিভিন্ন মঞ্চে গান পরিবেশনের পাশাপাশি বেশকিছু চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেছেন। তাছাড়া ভারতের সঙ্গীত শিল্পী পাপন ভারতের তরুণ প্রজন্মের কাছে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী পাপন নামেই বেশি পরিচিত। আসামের দুই জনপ্রিয় শিল্পী খগেন মহস্ত ও অর্চনা মহন্তের সন্তান পাপনের গানের সঙ্গে পরিচয় ছোটবেলায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গানের সঙ্গে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার পাপনের গানে লক্ষ্য করা যায়। ২০০৫ সালে প্রথম আসামীয় গানের অ্যালবাম ‘জোনাক রাতি’ মুক্তি পায়। এই এ্যালবামের মাধ্যমে তিনি আসামের শ্রোতাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এর মাঝে বাংলাদেশের সঙ্গীত অনুরাগীদের কাছে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন জনপ্রিয় গান ‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি...’ দিয়ে। পাপন একই সঙ্গে বাংলা, আসামীয়া এবং হিন্দী ভাষায়ও গান গেয়ে থাকেন। উৎসবের দ্বিতীয় দিন উৎসবের শুরুতে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত ব্যান্ড বাউলা, লোকসঙ্গীত শিল্পী আরিফ দেওয়ান, শাহজাহান মুন্সী, নেপালের কুটুম্বা, পাকিস্তানের মিকাল হাসান ব্যান্ড এবং ভারতের খ্যাতনামা দুই বোন নুরান সিস্টার্স গান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠান সমাপনী দিন প্রথমেই মঞ্চ মাতাতে আসেন বাংলাদেশের শাহনাজ বেলী। এরপর একে একে গান পরিবেশন করেন ডেনমার্কের শিল্পী মিকায়েল হেমনিতি উইনথার। ১০ জনের দল নিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মঞ্চে ওঠে ইরানের গানের দল রাস্তাক। অপরূপ সাজপোশাক আর অভিনব সব বাদ্যযন্ত্র দিয়ে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম ভরা দর্শকদের নাচিয়ে ছাড়ে তারা। ভালুক এবং পাশবালিশের মতো দেখতে এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মঞ্চের এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি নেচে বেড়ান একজন। পরিবেশনা শেষে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে সেই নেচে বেড়ানোর জবাব দেন দর্শক। রাস্তাকের পর মঞ্চে আসেন ভারতের বাসু দেব বাউল। তাঁরা শোনান পরিচিত বেশ কিছু গান। গানের তালে স্টেডিয়ামের ভেতরে গোলাকার বৃত্ত হয়ে নাচেন দর্শকেরা। রাত ১২টার একটু আগে মঞ্চে ওঠে গ্র্যামি বিজয়ী মালির গানের দল তিনারিওয়েন। অসাধারণ পরিবেশনা দিয়ে মাতায় তারা। এর মধ্যে দিয়ে শেষ হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব-২০১৭। এবারের আয়োজনে বাংলাদেশসহ মোট আটটি দেশের ১৪০ জন লোকসঙ্গীতশিল্পী অংশ নেন। প্রথম দিন সন্ধ্যা থেকে শেষ দিন পর্যন্ত মধ্য রাতব্যাপী লোকসঙ্গীতের সুরের জাদুতে মুগ্ধ ছিলেন উপস্থিত শ্রোতাদর্শক। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই বিকেল থেকে আর্মি স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে লক্ষ্য করা গেছে উৎসব উপভোগ করার জন্য দর্শকদের লম্বা লাইন। তারা ধৈর্য সহকারে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন। তবে অনুষ্ঠানে কিছু ত্রুটি লক্ষণীয় ছিল অনুষ্ঠানস্থলে সাধারণ দর্শক এবং সাংবাদিকদের গাড়ি পার্কিংয়ের কোন ব্যবস্থা না থাকায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। অনেকেই বলেন, ‘এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কিন্তু কোন পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আমরা গাড়ি না নিয়ে আসলে মধ্যরাতে অনুষ্ঠান শেষ হলে বাসায় ফিরব কিভাবে। অন্তত বাইক রাখার ব্যবস্থা করার দরকার ছিল।’
×