ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সহিংস কর্মকাণ্ড অহিংস বুদ্ধের অনুসারীদের

প্রকাশিত: ১৮:৩৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সহিংস কর্মকাণ্ড অহিংস বুদ্ধের অনুসারীদের

অনলাইন ডেস্ক ॥ বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি ‘অহিংসা পরম ধর্ম আর জীব হত্যা মহাপাপ’-মর্মবাণীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে এই কথিত অহিংস ধর্মের বৌদ্ধরা লাল কাপড়ের আড়ালে পৃথিবীর নৃশংসতম সহিংস কাপালিক জাতি হয়ে উঠেছে মিয়ানমারে। সেখানে প্রায় ৬ কোটি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীর বসবাস। মহামতি গৌতম বুদ্ধের বিশেষভাবে আলোচিত বাণী—‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু (বিশ্বের সকল প্রাণী সুখী হোক) কে পরম ধর্মজ্ঞান করতে বলা হলেও তা কেবল গ্রন্থেই পড়ে রয়েছে। অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা এই ধর্মের অনুসারীদের দেখা যায় দেশে দেশে সহিংস বিগ্রহে। বর্তমানে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গোঁড়া বৌদ্ধরা নিরামিষ ভোজী হলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধিকাংশই জীব হত্যা মহাপাপের নীতি থেকে সরে এসে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে জীবের মাংস ভক্ষণ করেন। তাদের ধর্মগ্রন্থে কোনো বৌদ্ধ ‘মহাপাপ’ করে ফেললে তার কোনো রকম বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থার কথা স্পস্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। তবে তাদের ধর্মবেত্তারা বলে থাকেন, বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী একজন মানুষ খুন, হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাস ও অন্যান্য বড় বড় অপরাধ করার পর সেই ব্যক্তি নিজের অন্তরে অশান্তি বা শাস্তি অনুভব করে- এটাই তার অপরাধের শাস্তি। ধর্মগ্রন্থে পাপের শাস্তির কথা না থাকার ফলে সহিংস জাতি হয়ে ওঠার সুযোগ আছে তাদের। চার বছর আগে মিয়ানমারের উগ্রবাদী সহিংস এক বৌদ্ধ ভিক্ষু নেতাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল-বৌদ্ধ সন্ত্রাসবাদীর চেহারা’। খুন পিয়াসী বৌদ্ধ নেতা উইরাখু কিভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিধনে উস্কে দিচ্ছেন তাই তুলে ধরা হয় টাইম ম্যাগাজিনের এ প্রচ্ছদ কাহিনিতে। সেখানে বলা হয়, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র বৌদ্ধদের হামলা, ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। সেখানে বৌদ্ধরা অহিংস নয়, ভয়ঙ্কর সহিংস। ‘মা বা থা’ নামে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি জঙ্গি সংগঠন বহু বছর ধরে মিয়ানমারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিধন ও বিতাড়ন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে তাদের হত্যা ও সম্পত্তি বিনষ্ট করতে উত্সাহী করে তোলাই ‘মা বা থা’র কর্মীদের প্রধান কর্মসূচি। গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য আটটি নিয়মনীতির প্রচলন করেছিলেন। যে নীতিগুলোকে এক কথায় অষ্টমার্গ বলে। এ আটটি নীতিবাক্যের সার কথা হচ্ছে— ‘কোনোভাবেই জীব হিংসা করবে না এবং সত্য বলবে আর সত্পথে চলবে।’ সাধারণ গৃহিণীদের জন্য ১০টি নিয়মনীতির প্রথমেই আছে, ‘তুমি কোনো জীব হত্যা করবে না।’ বৌদ্ধ ধর্মে নিজের প্রাণের মতো সব প্রাণীকে দেখা হয়েছে,সব প্রাণীর জীবন রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে, আর অন্যান্য ধর্ম মানবজীবনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে বুদ্ধের অহিংসা ধর্মের ‘মগা’রা কুখ্যাত চেঙ্গিস হালাকু খাঁর বর্বরতাকেও হার মানাচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের মুণ্ডহীন দেহ আর কর্তিত মস্তক রাস্তার পাশে প্রদর্শন করা হচ্ছে। নারী-পুরুষ ও শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, মিয়ানমারের এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অতীত হতেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনাচার-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন করে আসছে। মগা নামে তারা কুখ্যাত। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে—“রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস, দক্ষিণে বার্মার বংশোদ্ভূত ‘মগ’ ও উত্তরে ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। মগদের দস্যুবৃত্তির কারণেই এই কথার উত্পত্তি। একসময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোঘলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।” “পর্তুগীজ নৌ-দস্যুদের সঙ্গে যখন আরাকানী বৌদ্ধরা হাত মিলিয়ে বাংলার উপকূলীয় এলাকায় সম্ভ্রমহরণ-লুণ্ঠন-হত্যার মতো জঘন্য কর্মে লিপ্ত হয় তখন থেকেই ‘মগ’ ও ‘মগের মুলুক’ জাতি ও দেশবাচক শব্দ দুটি অরাজকতার নামান্তর রূপে ব্যবহূত হতে থাকে। বাংলার ধন-সম্পদ লুণ্ঠনকারী ঐসব বৌদ্ধ মগ নৌদস্যুদের বংশধররাই হচ্ছে আজকের মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়। স্বাধীন রাজ্য আরাকানে দুইশ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে ১৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দের পর। সেখান থেকেই শুরু রোহিঙ্গাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের। ১৬৬০ সালে আরাকানের রাজা থান্দথুধর্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে হত্যা করে এবং মুসলমানদের ওপর শুরু করে অমানবিক নির্যাতন। ১৭৮০ সালে আরাকান স্বাধীনতা হারায়। বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। ঘোর মুসলিম বিরোধী রাজা বোধাপোয়াও অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করে। এরপর ইংরেজ শাসনের অধীনে চলে যায় বার্মা। ১৯৩৭ সালে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয় বার্মাকে। এ সময়টাতে সাম্প্রদায়িকতা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, দাঙ্গায় নিহত হয় ৩০ লাখ মুসলিম। ১৯৪৮ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পরও, রোহিঙ্গা তথা বার্মার মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার শেষ হয়নি। গোটা বিশ্বে বর্তমানে ৩৮ কোটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর বসবাস। তাদের ধর্ম আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত একটি বিশ্বাস এবং জীবন দর্শন। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত। প্রধান অংশটি হচ্ছে হীনযান বা থেরবাদ (সংস্কৃত: স্থবিরবাদ)। দ্বিতীয়টি মহাযান নামে পরিচিত। বজ্রযান বা তান্ত্রিক মতবাদটি মহাযানের একটি অংশ। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান, নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কোরিয়াসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এই ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বাস করেন চীনে। কেবল মিয়ানমার নয় বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধদের দ্বারা মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগত সম্প্রদায়। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হচ্ছে সিংহলী আর ১২.৫ শতাংশ তামিল জাতিগোষ্ঠীর লোক। অতীতেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরমপন্থি বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের উসকানির কারণে শ্রীলঙ্কায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মহল্লায় হামলার পর কলম্বোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আক্রমণ চালায় বৌদ্ধরা। কম্বোডিয়ার মুসলমানরা খেমাররুজ গেরিলাদের দ্বারা সমূলে উত্খাত হয়েছে। মুসলমানদের জনসংখ্যার হার ৬% থেকে নেমে ২.৪%-এ দাঁড়িয়েছে। তিব্বতের মুসলমানরা ১৯৫৪ সালে সমূলে উত্খাত হয়েছেন। ভিয়েতনামে চাম জনগোষ্ঠীভুক্ত মুসলমানদের এককালে প্রভাবশালী অবস্থান থাকলেও তারা আজ সমূলে উত্খাত হয়েছেন। চীন ১৯৭৩ সালে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউনান প্রদেশ দখল করে নেয় এবং এই সময় সমগ্র চীনে এক কোটি মুসলমানকে হত্যা করা হয়। থাইল্যান্ডে পাত্তানীর এক সময়ের মুসলিম সালতানাত আজ থাই বৌদ্ধদের নির্মমতার শিকার। চীনের উইঘুর মুসলমানরা হান বৌদ্ধদের আগ্রাসনের মুখে নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে অস্তিত্বের হুমকিতে। ভুটানে মুসলিমদের জন্য মসজিদ নির্মাণ অনুমোদনযোগ্য নয় । বাংলাদেশের উপজাতিগুলোর বৃহত্তর অংশ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। বৌদ্ধ ধর্মে স্রষ্টার কোনো ধারণা নেই। বলা হয়ে থাকে বুদ্ধও নাকি স্রষ্টার প্রশ্নে নীরব ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ধর্মগ্রন্থকে স্রষ্টার বাণী হিসেবে বিশ্বাস করা হয় না। বৌদ্ধরা জন্মান্তরবাদ তথা কর্মের ওপর ভিত্তি করে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বিশ্বাস করে।
×