ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধুমাসে আম দাওয়াত

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২০ মে ২০১৭

মধুমাসে আম দাওয়াত

আইলো দামান উত্তর দিয়া, আম পাড়লো লগি দিয়া, দামান মিয়ার মুখে হাসি শাউড়ি করে কানাকানি... আইলো দামান দখিন দিয়া কাঁঠাল পড়লো ধুপ্পুস কইরা, শাউড়ি হাসি দিল ফিক্কিত কইরা... নিকট অতীতে গ্রামীণ জীবনে জ্যৈষ্ঠের আম কাঁঠালের নিমন্ত্রণে এমন গীত গেয়ে জামাইবরণ করে নেয়া হতো। অনেক গ্রামে আজও জামাইকে ‘দামান’ সম্বোধন করা হয়। কেউ বলে দামান মিয়া। শাশুড়িকে ডাকা হয় শাউড়ি। দামান যেদিক দিয়ে আসে গীতের শুরু হয় সেইদিক উল্লেখ করে। যেমন আইলো দামান পূর্ব/পশ্চিম/উত্তর/দক্ষিণ দিয়া...। নিকট অতীতে মধুমাসের নিমন্ত্রণে জামাই ও স্বজনদের নাউর যাওয়ার বাহন ছিল রেলগাড়ি। তারপর বাকি পথটুকু গরু ও মোষের গাড়িতে চড়ে যেতে হতো। বাস সার্ভিস খুব কমই ছিল প্রত্যন্ত এলাকায়। বর্তমানে গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো এতটাই উন্নত যে ঘরের দুয়ারে যন্ত্রচালিত যানবাহন মিনি বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা ভিড় করে। ঠেলাগাড়িতে করে যাত্রী পরিবহনও কমেছে। নাইওর যাওয়ার ইচ্ছা হলে যানবাহন আজ আর কোন ফ্যাক্টর নয়। বাঙালীর ঐতিহ্যের সংস্কৃতিতে জ্যৈষ্ঠ মধুমাসের স্বীকৃতি পেয়েছে অনেক আগে। যার ধারাবহিকতায় জাতীয় ফল হয়েছে কাঁঠাল। আর জাতীয় বৃক্ষ হয়েছে আমগাছ। একই সঙ্গে ফলের রাজা হয়েছে আম। সেই হিসেবে ফলের সম্রাট কাঁঠাল। রাজা আর সম্রাট অধিষ্ঠিত আসনের মতোই জ্যৈষ্ঠের মধুমাসে দামান মিয়া শ্বশুরবাড়িতে ওইসব ফলের মতোই আসন পায়। আম কাঁঠাল খেয়ে দামানের মুখে হাসি দেখে গ্রামের তরুণরা বলে ওঠে ‘দামান মিয়া সলিড’। দামান মিয়ার এমন অভিধায় জামাই বাবাজিকে বেকায়দার ফেলে দেয় শ্যালিকারা। বগুড়া অঞ্চলে জ্যৈষ্ঠের মধুমাসে নিকট অতীতে সোনাতলা এলাকায় গীত ছিল এমন- ‘বাউলা হাটোতি বিছার দোকান বসাইছে দামান গো বিছা কিনা দিলা না...’ (বাউলা হাটে বিছার দোকান বসেছে দামান তুমি বিছা কিনে দিলে না)। বিছা এক ধরনের গহনা। সোনা বা রূপায় বানানো বিছা মেয়েরা কোমরে পরে। মধুমাসে জামাই আদর যতœাদি পাবে আর খরচ করবে না তা কি হয়? মধুমাসে শুধু জামাই নয় গ্রামে নাইওর যাওয়ার ধূম পড়ে যায়। মেয়ে জামাই তো আসেই, আত্মীয়স্বজনকেও নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। জৈষ্ঠ মাস পড়লেই বাঙালীর শ্বশুরকুল জামাইকুল নাতি নাতনিরকুল নানানানি দাদাদাদির কুলে যে আনন্দের নাচন শুরু হয় তা আর কখনও হয় না। নিমন্ত্রণের কথা থাকে এ রকম- ‘বাবাজীবন মেয়ে নাতিনাতনিকে নিয়ে আম কাঁঠাল খেতে আসতে হয়।’ মধুমাসের এমন মধুময় ডাক একেবারেই স্বর্গীয়। এই সময়টায় আম জাম কাঁঠাল লিচু আনারস জামরুল পানিফল বেল আমলকী তালের শাঁস ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে ক্রেতার দিকে। এমন নিমন্ত্রণ ‘আম দাওয়াত’ নামে পরিচিত। আম দাওয়াত কথাটি প্রবাদেও ঠাঁই পেয়েছে। এমন পুলকে মেয়ে নাইওর যেতে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে আগেভাগেই। জৈষ্ঠের মধুমাসের আম নিয়ে প্রবাদে রূপকে কত যে কথা চালু হয়েছে! সাধারণ জনতাকে বলা হয় আমজনতা। ওয়াকফর মোতাওয়াল্লীর পরিচালককে বলা হয় আমমোক্তার। ফলের নাম আম কথাটি কিভাবে এলো তা ঘেটে দেখা যায়- বিহারের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বৈশালীর বিখ্যাত নারী নিজে আম্রপালি নামে দীক্ষিত হন। যার প্রথম দুই অক্ষর আম্র সংস্কৃত শব্দ থেকে আম নামটি বাংলা ভাষায় আসে। গত শতকের ’৯০-এর দশকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষণা ইনস্টিটিউট আম্রপালী নামের জাত উদ্ভাবন করে। পুরানের সেই আম্র শব্দটি ফিরে আসে আমের মধ্যে। জৈষ্ঠের মধুমাসে ফলের রাজা আম চিরন্তন হয়ে আছে। আম আর কাঁঠাল এই দুই ফল কেউ কাউকে হারাতে পারবে না। মধুমাসে জাতীয় ফল কাঁঠাল প্রত্যেক বাড়িতেই আসে। কাঁঠাল দেখে খুশি হয় সরষের তেল। হাতে মুখে আঠা লাগবেই। এ নিয়েও প্রবাদ আছে কাঁঠালের আঠা লাগলে নাকি ছাড়ে না। তারপরও কাঁঠালের ভেষজ গুণ অনেক। মেয়েদের মুখে ব্রন সারাতে রং ফর্সা করতে বিউটি পারলারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কাঁঠালের মৌসুমে ৭/৮টি কোয়া খাওয়ার পর একটি বীজ চিবিয়ে রস খেলে হজম শক্তি ভালো থাকে। এছাড়াও কাঁঠালের দ্রব্য ও ভেষজ গুণ দুই-ই আছে। বীজের (কাঁঠালের বিচি নামেই অধিক পরিচিত) ভর্র্তা ও ভাজি মুখে লেগে থাকে। একটা সময় মধুমাসে কাঁঠাল দিয়ে পান্তাভাত খাওয়া হতো। রাতে খাবার শেষে আম কাঁঠাল চিপে রস করে দুধভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। জ্যৈষ্ঠের এই মধুমাসে সরকারী বড় কর্তাদের রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিনাজপুর টাঙ্গাইল সিলেট জেলা সফরের হিড়িক পড়ে। ফেরার সময় বড় কর্তাদের গাড়িতে আম কাঁঠাল লিচু আনারসসহ মধুমাসের মধুফল খিলখিল করে হাসে। আম বেচাকেনা নিয়েও মজার কথা আছে। বগুড়া নাটোর কুষ্টিয়া অঞ্চলে ষাটের দশকে একশ’ আমের হিসাব হতো দুইশ’ আমে। অর্থাৎ আমের আঁটি বিক্রির মধ্যে ধরা হতো না। তাই একশ’ আমের হিসাবে দুইশ’ আম। এখন কি কেউ কল্পনা করতে পারে এই হিসাবের কথাটি! মধুমাসে এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে আম ঢোকেনি। আমের ইতিহাসে দেখা যায়- মুঘল স¤্রাট আকবর বিহার রাজ্যের দারভাঙ্গায় একলাখ আম গাছ রোপণ করেন। এই বাগানের নাম হয় ‘লাখবাগ’। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রীষ্মকালে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। সে সময় আম খেয়ে দারুণ মজা পেয়ে তিনি আম রসনার ভক্ত হয়ে পড়েন। প্রাচীন চীনা পরিব্রাজক উপমহাদেশে আমের জন্যই মালদা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় দীর্ঘ সময় থাকেন। পারস্যের বিখ্যাত কবি আমির খসরু আমকে নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। ইতিহাসেরও আগে পুরানে আম গাছকে বলা হয় কল্পবৃক্ষ বা ইচ্ছা পূরণের বৃক্ষ। পরিষ্কার মনে কল্পতরু আম গাছের নিচে বসে কেউ হৃদয়ের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তা পূরণ হয় (!)। এই কারণে ভারতের হস্তশিল্পের বাজারে আমের আকৃতির বাহুবন্ধনী পাওয়া যায়। জ্যৈষ্ঠে লোকসঙ্গীত উপজাতীয় নৃত্যেও এসেছে আম। প্রেমের দেবতা কিউপিড তীরের অগ্রভাগে আমের মুকুল এঁটে নেয়। মধুমাসের ফলের মধ্যে আমই থাকে দীর্ঘ সময়। লিচু আসে কম সময়ের জন্য। সিলেটের আনারস, মধুপুরের ক্যালেন্ডার আনারস, জামরুল, জাম, লটকন, গোলাপজাম, তালশাঁস আম কাঁঠালের সঙ্গী হয়ে আসে। ছেলেবেলা কে কত জাম খেয়েছে তার প্রমাণ দিতে হয়েছে জিহ্বায় রং দেখিয়ে। বেশিরভাগ ফলই তাড়াতাড়ি বাজার থেকে উঠে যায়। অনেকটা সময় ধরে টিকে থাকে আম কাঁঠাল। ফলের রাজা আমকে ঘিরেই কার্যত বাঙালীর মধুমাস। আজও শিশু কিশোররা আমের আঁটি চিরে ভেপু বাঁশি বাজায়। এই বাঁশি যতই বেসুরো হোক তবুও মধুমাসের মধুসুর...। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×