ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গাঙপাড়ের মেলা

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২২ এপ্রিল ২০১৭

গাঙপাড়ের মেলা

মেলা শুধু মুড়ি মুড়কি মিষ্টি খাওয়ার নয়। মাটির পুতুল কিংবা প্লাস্টিকের খেলনা কেনা নয়। নয় শুধু বিনোদন। মেলা মানুষের মিলনমেলাও বটে। আবহমানকাল থেকে মেলা মানুষে মানুষে মিলন ঘটিয়ে এসেছে। দীর্ঘ বিরতির পরে স্বজনের সঙ্গে স্বজনের দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এ মিলন ঘটেছে বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায়। নদীর শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে বৃক্ষতলায় বসে মানুষ গেয়েছে মিলনের গান। তাই তো মেলার আরেক নাম বটতলার মিলনমেলা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মেলার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটা সময়ে প্রধানত গাঁয়ের জমিদার কিংবা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা মেলার গোড়াপত্তনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছে। নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ছাড়া নামযশ চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া, এর প্রধানতম লক্ষ্য ছিল। কেউ কেউ মেলা বসিয়ে নানাভাবে অর্থ উপার্জনও করেছে। আবার বহু মেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় কারণেও বহু মেলার উৎপত্তি ঘটেছে। মেলা আয়োজনের জন্য বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো। যার অন্যতম হচ্ছে স্থান নির্বাচন। দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি মেলা ঘুরে দেখা গেছে, এর সবই যেমন নদীর পাড়ে। তেমনই গাছের নিচে। নৌনির্ভর অঞ্চল। তাই যাতায়াতের সুবিধার জন্য নদীর তীর নির্বাচন। প্রকৃতিকে ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য গাছের নিচে মেলা হতো। সারি বেঁধে দোকান বসত গাছের নিচেই। আবার দূর-দূরান্ত থেকে আসা পরিশ্রান্ত মানুষ মেলায় এসে পেত ছায়া সুনিবিড় শান্ত পরিবেশ। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও আজকের দিনের মতো বিনোদনের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য মাধ্যম ছিল না। গাঁয়ের পরিশ্রমী মানুষ সব ধরণের বিনোদন থেকে ছিল বঞ্চিত। জীবন ছিল একঘেয়ে। সকালে ক্ষেতে নামা। রাতে বাড়িফেরা। এ ছিল নিত্যকার রুটিন। এ অবস্থা থেকে কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষসহ সব শ্রেণী-পেশা বয়স নির্বিশেষে নারী-পুরুষকে মেলা দিয়েছে বিনোদনের অপূর্ব স্বাদ। তিন-চারদিনের নদী পথ পাড়ি দিয়েও বহু মানুষ মেলায় যোগ দিয়েছে। চার-পাঁচ গ্রাম পায়ে চলা পথ পেরিয়ে মেলায় যাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা। মেলার ক’দিন আগ থেকে গোটা গ্রামের বাড়িঘর ভরে যেত আত্মীয়স্বজনে। তাই তো মেলা শুধু বিনোদন কিংবা খাওয়া নয়Ñ এটি মানুষের মিলনেরও মেলা। অনেকদিন পরে গাছের ছায়ায় জমে ওঠা মেলায় দেখা হয়েছে স্বজনদের সঙ্গে। প্রাণ খুলে চলেছে আড্ডা আর সুখ-দুঃখের আলাপ। সাংসারিক কেনাকাটার প্রয়োজন মিটেছে মেলা থেকে। অনেকে ব্যবসায়িক কাজকর্মও সেরে নিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি মেলারই পৃথক নাম ছিল। যেমন দয়াময়ীর মেলা। শিবের মেলা। দরবেশের মেলা। বৈশাখী মেলা প্রভৃতি। কিন্তু এর পরেও স্থান-কালভেদে ঐতিহ্য অনুযায়ী বহু মেলা আলাদা নামেও পরিচিত ছিল। যেমন গাঙপাড়ের মেলা। বটতলার মেলা কিংবা বটপাকুড়ের মেলা। দিন পাল্টেছে। সময় পাল্টেছে। ঐতিহ্যের বহু মেলা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার নতুন নামে বহু মেলার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পাল্টায়নি মেলার অনুষঙ্গ। আজও গ্রামীণ মানুষের কাছে মেলা সমান প্রিয়। যেখানে মানুষ খুঁজে পায় নিজেকে। -শংকর লাল দাশ গলাচিপা থেকে
×