ছেলেটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। চুলগুলো উসকো-খুশকো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। গায়ে হালকা গোলাপী রঙের শার্ট, পরনে জিন্স প্যান্ট। পায়ের জুতোটা দুই ফিতার। হাবভাবে বোকা-সোকা। আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। মাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে বেশ লাজুক। আমি তাকে বসতে ইশারা করলাম। নীরবে বসে পড়ল।
‘আমাকে চিনতে সমস্যা হয়নি তো?’
‘জি-না’
‘কিভাব চিনলেন? আগে তো দেখেননি’
‘ছবিতে দেখেছি’
‘আমি কি ছবির মতোই সুন্দর? নাকি তার বেশি বা কম?’
‘সামান্য বেশি’
‘আপনি কি মেপে মেপে কথা বলেন সব সময়?’
‘জি-না। শুধু চিন্তার মধ্যে থাকলে বলি’
‘এখন কি চিন্তায় আছেন?’
‘আমাকে আপনার পছন্দ হবে কি-না সেই চিন্তা’
‘আপনার কি মনে হয়? পছন্দ হবে?’
‘মনে হচ্ছে হবে না’
‘কেন এমন মনে হলো আপনার?’
‘পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলেছি। আপনার আগেও সাত জন মেয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাদের কারও আমাকে পছন্দ হয়নি’
‘তারা পছন্দ না করার পেছনে কি কি যুক্তি দাঁড় করিয়েছে’
‘অনেক যুক্তি। এই যেমন-আমি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না, দেখতে বোকার মতো, গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, চোখে কম দেখি। আরও অনেক আছে। আমি সবগুলোর একটা লিস্ট করে রেখেছি। যদি কখনও কাজে লাগে এই ভেবে। চাইলে আপনিও দেখতে পারেন। এর বাইরে নতুন কোন কারণ থাকলে সেটাও লিখে দিতে পারেন’
‘থাক লিস্ট দেখে কাজ নেই। যা বুঝে যাওয়ার এমনিতেই বুঝে গেছি।’
‘আমার বিষয়ে আপনার কিছু জানার আছে? থাকলে বলুন। পড়ে হয়ত সুযোগ পাবেন না।’
‘আপনি অনেক সুন্দর। আমার ধারণা আপনার মনটাও সুন্দর। আপনার কথা শুনে বোঝা যায় আপনি অনেক মেধাবী। আপনি আমার মতো বোকা ছেলেকে বেশ সামলাতে পারবেন। বাকিটা আপনার ইচ্ছা’
‘আপনি যে অনেক চালাক এটা কি আপনি জানেন?
‘জানতাম না। মাত্রই জানলাম। বাকিটা জীবনও জানার সুযোগ হয়ত পাব।’
‘স্যালারি কত পান? বলতে আপত্তি না থাকলে বলুন। জোর করছি না।’
‘পনের হাজার টাকা। সামনে মাসে আরও একটু বাড়বে।’
‘আমি পড়াশোনার ফাঁকে একটা পার্টটাইম জব করি। স্যালারি দশ হাজারের মতো। পঁচিশ হাজার টাকায় দুজনের সংসার বেশ আরাম-আয়েশেই কাটবে। কি বলেন?’
ছেলেটি আর কোন কথা বলেনি। দৌড়ে গিয়ে লাল, নীল আর হলুদ রঙের তিনটি বেলুন কিনে আনল। তার মন অনেক ভাল থাকলে আকাশে বেলুন উড়ায়। আমি তার শিশুসুলভ আচরণ দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। আজও সমান তালেই আনন্দ পাচ্ছি। আমাদের বিয়ের আজ তিন বছর পূর্ণ হলো। তার জন্য জ্যোৎস্না রাতে ছাদে বসে অপেক্ষা করছি। আমার শরীরে তার পছন্দের শাড়ি জড়ানো। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। রাত প্রায় শেষের দিকে। জানি সে আর আসবে না। বড্ড অভিমান করেছে হয়ত। আচ্ছা, সেকি বুঝতে পারে আমি তাকে নিয়ে বেশ ভাল আছি। নিশ্চয় বুঝবে। আমি তার কথা রেখেছি। আমার মনে তার ভালবাসাকে জীবন্ত করে রেখেছি। চিরটাকাল রাখব। শুধু মাঝে মাঝে ভীষণ আফসোস হয়। সেদিনের সে এ্যাক্সিডেন্টে দুজনারই মরে যাবার কথা ছিল। তবে আমি কেন বেঁচে গেলাম। সে কেন একা চলে গেল? আমি এক জোড়া ছলছল চোখ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
এই শুনছো? আমি ভাল আছি।