ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফুটবল বিশ্বে শোকের ছায়া

বিদায় কালো মানিক, বিদায় ফুটবলের রাজা

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২

বিদায় কালো মানিক, বিদায়  ফুটবলের রাজা

ভক্ত অনুরাগীদের কাঁদিয়ে ৮২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন ফুটবল সম্রাট পেলে

জীবন নামের খেলাঘর থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার, ফুটবলের রাজা, কালো মানিক পেলেযার পুরো নাম এডসন আরান্টেস ডো নাসিমেন্টোবিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীকে কাঁদিয়ে আর শোকের সাগরে ভাসিয়ে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপজয়ী তারকা পেলেব্রাজিলের সাওপাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর লড়াই শেষে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনিপেলের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর

১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের এক বস্তিতে জন্ম নেওয়ার পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজেকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেন পেলেখালি পায়ে ফুটবল মাঠে পদচারণা শুরুর পর পায়ের জাদুকরী ছোঁয়ায় গ্রাম-শহর ছাপিয়ে আর দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বুকে আলো ছড়ানপঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকে পুরো বিশ্বে মুগ্ধতা ছড়ান এই মহাতারকাঅবিশ্বাস্য ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিয়ে হৃদয় জয় করেন পুরো বিশ্বেরযে কারণে ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠেন কালো মানিকতাক লাগানো সাফল্যের কারণে ফুটবলের রাজাহিসেবে তাকে এক নামে চেনে প্রজন্মের পর প্রজন্মফুটবল পায়ে জাদুকরি দক্ষতা আর অবিশ্বাস্য সব কীর্তিতে হয়ে উঠেছেন খেলাটারই প্রতীকসাওপাওলোর দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় খালি পায়ে মোজা আর কাগজের ফুটবল দিয়ে খেলতে খেলতে হয়ে উঠেছেন রূপকথার চরিত্রফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন জীবনের মহানায়ক, অসংখ্য মানুষের প্রেরণার উ

অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য আর মুখে বিজয়ীর হাসি দিয়ে গোটা দুনিয়ার মানুষের হৃদয় জয় করেন পেলেমূলত তার কারণেই ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয় ফুটবলফুটবলপাগল সাধারণ মানুষ তো বটেই; তার মোহনীয়  নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছেন পোপ, বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, হলিউড তারকা থেকে শুরু করে সবাইশুরুতে ফুটবল জাদুকর, পরে ফুটবল দূত হিসেবে প্রায় সাত দশকের ক্যারিয়ারে ফুটবলের সঙ্গেই ছিলেন তিনিকিন্ত প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ফুটবল মাঠের মহানায়ক, সর্বজয়ী পেলে দুরারোগ্য ক্যান্সারের কাছে শেষ পর্যন্ত হেরে গেছেনযে কারণে থেমে গেছে তার রঙিন ও বর্ণাঢ্য পথচলাদীর্ঘদিন ধরেই পেলে অসুস্থ ছিলেনকোভিড-১৯ মহামারির আগে থেকেই শারীরিকভাবে ভুগতে হয়েছে তাকেতখন থেকেই বাইরের ব্যস্ততা এক রকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিলঅনেকদিন থেকে সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারছিলেন না২০১২ সালে কোমরের অস্ত্রোপচারের পর থেকেই পেলের চলাচলে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়এরপর থেকে যতবারই জনসম্মুখে এসেছেন হয় ক্র্যাচে ভর করে, কিংবা হুইল চেয়ারে

গেল কয়েক বছরে কিডনি সমস্যার কারণেও বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে এই কিংবদন্তিকে২০১৯ সালে মূত্রনালির সমস্যার কারণে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলএর মধ্যে ২০২০ সাল থেকে পশ্চাদেশের সমস্যায় ভুগছিলেনএসবই একটা সময় ক্যান্সারে রূপ নেয়সেটার চিকিসা চলছিল গত বছর থেকেগত নভেম্বর মাসের শেষদিক থেকে হাসপাতালেই চিকিসা চলছিল তারহাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় খবর আসে, পেলের অবস্থা গুরুতরবিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে তাকেতবে কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার মেয়ে কেলি নাসিমেন্টো জানান, নিয়মিত চিকিসার অংশ হিসেবে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে তার বাবাকেএরপর থেকে মাঝেমধ্যে পেলের সন্তানরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবার শারীরিক অবস্থার কথা জানায়কিছুদিন আগে প্রকাশিত চিকিসকদের রিপোর্ট ও পরিবারের ভাষ্য থেকে জানা যায়, পেলের ক্যান্সারের অবস্থার অবনতি ঘটেছেহাসপাতালে তার চিকিসা চলবে বলেও জানানো হয়ডিসেম্বর মাসের শুরুতে চিকিসকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, কেমোথেরাপিতে পেলের শরীর আর সাড়া দিচ্ছে নাএতে তার সুস্থ হয়ে ওঠার আশা এক রকম শেষ হয়ে যায়এবারের বড় দিনও হাসপাতালেই কেটেছে তারশুধু তাই নয়, বিশ্বকাপ ফুটবলও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দেখতে হয়েছেসেখান থেকেই অবশেষে চিরবিদায় নিয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলে

এর ফলে ফুটবলবিশ্ব সর্বকালের সেরা দুই তারকাকেই হারিয়েছেএর আগে সর্বকালের আরেক সেরা ফুটবলার আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরও দুনিয়ার মায়া ছেড়েছেনম্যারাডোনা মারা যান ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বরএর দুই বছর পর অনন্তলোকে পাড়ি জমান পেলেওযে কারণে ফুটবলবিশ্বে সৃষ্টি হলো একরাশ অপূর্ণতাকিংবদন্তি পেলে সবমিলিয়ে তার ২১ বছরের খেলোয়াড়ী জীবনে বিশ্বরেকর্ড ১২৮১ গোল করেছেন ১৩৬৩ ম্যাচ খেলেএর মধ্যে ব্রাজিলের জার্সিতে ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত খেলে ৯২ ম্যাচে করেছেন ৭৭ গোলপেলের পায়ের জাদুতে ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জয় করে সেলেসাওরাসর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনবার জিতেছেন বিশ্বকাপ ট্রফি

অথচ অতলস্পর্শী দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছিলেন পেলেভালো খাবার, প্রশিক্ষণ এমনকি পকেট মানিও জুটত নাকিন্তু ফুটবল ছিল নেশাবিশাল এক নাম নিয়ে জন্মেছিলেনস্কুলে বোকাসোকা ছেলেটি তাদের সময়কার সেরা তারকা ভাস্কো ডা গামা নামে পরিচিত বিলেকে ভুল করে ডাকতেন পিলেহাসাহাসি আর ঠাট্টার শিকার কালো ছেলেটির সেই থেকে নাম হয়ে গিয়েছিল পেলেকে জানত এই পেলেই হবেন ফুটবলের কালো মানিক, বিশ্বের সেরা ফুটবলারযখন ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড়দের জন্ম হয়নি তখন শিল্প ও শৈলীতে ভুবন মাতানো পেলের রেকর্ড আকাশচুম্বীএকের পর এক নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়া ব্রাজিলের এই খেলোয়াড় আজীবনই কিংবদন্তিযার তুলনা কেবল তিনি নিজেই

আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা যেদিন মারা গেলেন, মনে হলো ফুটবলের বুক অনেকটাই খালি হয়ে গেলঅপ্রত্যাশিত ওই মৃত্যুর ঠিক দুই বছর এক মাস তিন দিন পর চলে গেলেন পেলেম্যারাডোনার আবির্ভাবের আগে ওই সময় পেলে মানেই ফুটবল; ফুটবল মানেই ছিল পেলেমানে পেলে ও ফুটবল একে অপরের পরিপূরক১৯৮৬ বিশ্বকাপে দিয়েগো ম্যারাডোনার আবির্ভাবে ধারণাটা কিছুটা বদলালেও পেলে ছিলেন ফুটবলের রাজার আসনেই।  দিয়েগো  ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর পেলে লিখেছিলেন, ‘বন্ধু, একটু আগেই তুমি চলে গেলেতবে একটু অপেক্ষা করো, আমিও আসছিস্বর্গের মাঠে আমরা ফুটবল খেলবস্বর্গোদ্যানে ফুটবলের মাঠ যদি সত্যিই থাকে, কার সাধ্য পেলে-ম্যারাডোনাকে আটকায়! তারা দ্রুতই হয়তো নেমে পড়বেন রোমাঞ্চকর চর্মগোলক নিয়ে!

একসময় ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন পেলেসেই সোনার ছেলের মৃত্যুতে ব্রাজিল তো কাঁদছেইশোকে আচ্ছন্ন গোটা দুনিয়াতার মৃত্যুর সংবাদ স্বাভাবিকভাবেই নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো ফুটবলবিশ্বকেদেশের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক, একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী মহাতারকাকে হারিয়ে শোকাহত লাতিন আমেরিকার দেশটিকিংবদন্তির প্রয়াণে ব্রাজিল সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেমাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক, ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপে আবির্ভাবেই জাদুর ছোঁয়ায় বিশ্ব ফুটবলকে বিস্ময়ে ভাসান পেলেতার নায়কোচিত পারফরম্যান্সেই ১৯৫৮ সালে সুইডেনের আসরে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করে ফুটবলের সেরা সাফল্যের দেশ ব্রাজিলএর তিন বছর পর ব্রাজিল সরকার পেলেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ঘোষণা করে১৯৬২ ও ১৯৭০ সালেও দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয় করেন পেলে

অবিশ্বাস্য সাফল্যের কারণে ২০০০ সালে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা পেলেকে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি দেয়ওই বছরই ফুটবল ভক্তদের ভোটে সর্বকালের সেরা হন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনাসেই থেকে পেলে ও ম্যারাডোনাকে যৌথভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার বলা হয়ে থাকেব্রাজিলের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা ডা সিলভার বার্তায় ফুটে উঠেছে, ফুটবলে পেলে কি ছিলেন, বল পায়ে পেলে কি করতেন, ‘আমার জীবনের বড় পাওয়া আমি পেলেকে খেলতে দেখেছিপাচায়েম্বু ও মোরুম্বিতে তাকে জীবন উপভোগ করতে দেখেছিযা আজকের তরুণ ব্রাজিলিয়ানরা পায়নিআমি দেখতাম পেলে মাঠে একটা দারুণ শো উপহার দিতযখন সে বল পেত, সবসময়ই বিশেষ কিছু করতযা প্রায় সময়ই গোল দিয়ে শেষ হতো

যে ক্লাবের ফুটবলার হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন; যে ক্লাবের মাঠে খেলেছিলেন জীবনের বেশ কিছু স্মরণীয় ম্যাচ সেই ক্লাব সান্টোসের মাঠেই অনুষ্ঠিত হবে কিংবদন্তি পেলের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানদুইদিন ধরে শেষকৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে

×