.
খুব ছোটবেলায় বইতে পড়েছিলাম- ‘আজ ঈদ। দলে দলে লোকজন ঈদগাহে চলিল।’ কি যে খুশির দোলা দিয়ে যেত এই দুটো লাইন। আজও কথাগুলো মনের কোনে গেঁথে আছে। ঈদ এলেই আগে লাইন দুটো ভীষণ মনে পড়ে। সময় বদলেছে, সেই ঈদের আমেজ এখন আর নেই। তবু এখনো চোখের কোনে সেই খুশি মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে যায়। আবছা মনে পড়ে- আমিও বাবার সঙ্গে মসজিদে যেতাম ঈদের নামাজ পড়তে। আমাদের সময় লেসফিতাওয়ালা আসত বাড়ি বাড়ি। কাপড়ে বাঁধা বিশাল একটা পুঁটলি। তার মধ্যে থরে থরে সাজানো ৪/৫টা বাক্স। সেগুলো ভর্তি থাকত সাজগোছের জিনিস- কোনোটায় থাকত চুড়ি, কোনোটায় মেকআপ, কোনোটায় আলতা-স্নো-পাউডারসহ অনেক কিছু! আর হাতে থাকত আরেকটা কাচের ঢাকনাওয়ালা পাতলা বাক্স সেটাতে থাকত কানের দুল, চুলের ক্লিপ, টিপসহ আরও কত কি। এসেই সে ডাক দিত- লেসফিতা রাখবেন, লেসফিতা- মায়ের কাছে বায়না ধরতাম, মা লেসফিতা কিনে দাও। মা সেখান থেকে ঈদের জামার সঙ্গে মিলিয়ে ফিতা, ক্লিপ, চুড়ি, লিপস্টিক, নেলপলিস, গালপলিস কিনে দিতেন। ব্লাশনকে বলতাম গালপলিস, সেটার নাম রোজ। মিষ্টি গোলাপি রঙের সেই গালপলিস দিয়ে গাল গোলাপি হয়ে যেত। লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে আর কথা বলতাম না, খেতেও চাইতাম না- লিপস্টিক মুছে যাবে তাই। আজ মা নেই, লেসফিতাওয়ালাও নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু যে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা বলাই মুশকিল।
বাবা ছোট একটা সরকারি চাকরি করতেন। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারে কেনাকাটার সেই জৌলুস ছিল না কখনোই। বায়নাও তেমন আকাশছোঁয়া ছিল না। যা কিনে দিয়েছেন তাই মনে হতো সবচেয়ে সুন্দর। থাকতাম মালিবাগে। মালিবাগ বাজার তখন অনেক বড়। যতদূর মনে পড়ে-বর্তমানে রেললাইনের পাশে যে বিশ্বরোড গেছে, সেই রাস্তা ছিল না। এখানেই পুরোটা ছিল বাজার। সেখানে শুধু মাছ, তরকারিই থাকত না- জামা, জুতা, সাজগোছের জিনিসসহ সংসারের প্রায় সবই পাওয়া যেত। বাবার হাত ধরে টুকটুক করে বাজারে যেতাম। তখন কুমকুম পাওয়া যেত, এক ধরনের সাজের জিনিস। সেটা দিয়ে কিভাবে সাজতে হয়, তখন তা জানতাম না। একটা কৌটার মধ্যে অনেকগুলো রং। দেখতে খুব সুন্দর। সাজি বা না সাজি, ওটা আমার চাই। বাজারের পাশেই ছিল বিপণি বিতান, যা পরে মালিবাগ সুপার মার্কেট নামে পরিচিতি পায়। এখন আর সেটাও নেই, ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওখান থেকে আমাকে সুন্দর নকশা করা প্লেট, বাটি, চামচ, লবণদানি কিনে দিতে হতো। ঈদে আমার সব আলাদা চাই। সেই প্লেট-বাটি ছিল টিনের। সুন্দর ফুল-লতা-পাতা নকশা করা। আমাকে ছোট্ট একটা প্লেট কিনে দেওয়া হয়েছিল। সেটার চারপাশে লতাপাতা, মাঝখানে একটা আম আঁকা ছিল। আর আমের মধ্যখানে লেখা ‘মা’। ওটাতে আমি দীর্ঘদিন ভাত খেয়েছি। ঈদের জামা-জুতা কেনা হতো মৌচাক মার্কেট আর গুলিস্তান থেকে। তখন টিউব মেহেদি ছিল না। গাছ থেকে মেহেদি পেড়ে বেটে চাঁদ রাতে মেহেদি দিয়ে বসে থাকতাম। প্রতিযোগিতা চলত- কার মেহেদি কত বেশি রং হয়।
ঈদের সকালের গোসলটা করিয়ে দিতেন বাবা বা বড় ভাইয়া, কসকো সাবান দিয়ে। কি সুন্দর ঘ্রাণ সেই কক্কো সাবানের (তখন কসকো সাবান বলতে পারতাম না)। স্বচ্ছ, এপাশ ওপাশ দেখা যায়। আজও প্রতি ঈদে আমার জন্য কক্কো সাবান বরাদ্দ থাকে। তবে সেই কক্কো সাবান আর নেই। সেই আনন্দও নেই। গোসল শেষে মা বা আপু সাজিয়ে দিতেন। মা কেন জানি চুলে চুপচুপ করে তেল দিয়ে দিতেন। সেই তেলা চুলে দুইটা বেণি বা ঝুটি করে দিতেন। সাজুগুজু করে সাথীদের সঙ্গে বেড়াতে বের হতাম। তবে কেউ সালামি দিলে নিতাম না, দৌড়ে বাসায় চলে আসতাম। অন্যের থেকে টাকা নেওয়াটা খুব লজ্জার মনে হতো। অথচ সবচেয়ে মূল আকর্ষণ হচ্ছে ঈদের সালামি। শুধু বাবা-মা-ভাই-বোনের কাছ থেকেই সালামি নিতাম। আর ঈদে বেড়াতে যেতাম পুরান ঢাকায় বড় খালার বাসায়। খালার সালামির পরিমাণ ছিল বেশি। সেটা নিতাম। তবে তখন সালামি ছিল ২ টাকা, ৫ টাকা। আমি সব সময় বাবার হাতে খেতাম। বাবা নামাজ পড়ে এসে আমাকে নিয়ে মায়ের রান্না খাবার খেতে বসতেন। তখনই আমার খাওয়া হতো। সারাদিন আর খাওয়া হতো না। ঈদের দিন কেন জানি ক্ষুধা অনুভব করতাম না। মা কত রকম রান্না করতেন। সায়েন্সল্যাব মোড়ে ‘শিউলি স্টোর’ নামের দোকানটায় এখন ছেলেদের পোশাক বিক্রি হয়। আমার ছোটবেলায় ওটাতে মেয়ে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করত। মা ওখান থেকেই সবচেয়ে সুন্দর ফ্রকটা আমার জন্য কিনে দিতেন, টুকটুকে লাল অথবা গোলাপি। নাম ছিল রানী ফ্রক। সঙ্গে থাকত একই রঙের হ্যাট আর ম্যাচিং জুতা।
‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ...’ এমন কোনো বাঙালি মুসলিম নেই এই গানের সঙ্গে যার মন নেচে ওঠে না। ঈদুল ফিতর আর কবি নজরুলের এই গান যেন একে অন্যের পরিপূরক। একটু বড় হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইফতার হাতে নিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম চাঁদ দেখব বলে। চাঁদ দেখতে না পেলে টিভি ছেড়ে এই গানের অপেক্ষা করতাম। এত বড় হয়েছি, সেই ছোটবেলার ঈদের খুশি আর সেভাবে মনকে উদ্বেলিত করে না, আপন মানুষগুলো নেই বলে। তবু এই গানটি শুনলেই এখনো মনের ভেতর থেকে হাজারটা প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না জানি। ছোটবেলার সেই সুখ-স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। বাবা-মা-ভাই-বোন নিয়ে সেই পরিপূর্ণ ঈদ আনন্দ করতে ইচ্ছা করে। রমজান মাস শুরু হলেই ছোট্টবেলাটা হাতছানি দিয়ে ডাকে। বাড়ির ছোট মেয়ে হিসেবে আদরটা একটু বেশিই ছিল। নতুন জামা কিনে লুকিয়ে রাখার কি প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল তখন। কেউ দেখে ফেললে জামা পুরনো হয়ে যাবে, আমার ঈদ শেষ হয়ে যাবে।
ছেলেবেলাটা সত্যিই অনেক মধুর ছিল! মনে হলেই কষ্টে ছাওয়া মনেও খুশির ঝিলিক দিয়ে যায়। জীবনের সবচেয়ে করুণ ঈদ ছিল মা মারা যাওয়ার পর। ২০০১ সালের ১৬ রমজানে মা চলে গেলেন। সেই রোজার ঈদটা ছিল সবচেয়ে বিষাদময়। শূন্য ঘর! রান্নার ব্যস্ততা নেই। কেউ ডেকে বলে না- তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হও, সেমাই খেয়ে মিষ্টি মুখ কর, এই যে তোমার পছন্দের কোরমা রান্না করেছি। দিনশেষে রাতেও কেউ আর অভিযোগ করে না- সারাদিন কষ্ট করে এত কিছু রান্না করলাম, একটু খেয়েও দেখল না। আজও ঈদ আসে। ঈদ এলেই এই কথাগুলো শোনার জন্য মন ব্যাকুল হয়। দিনশেষে তা একটা দীর্ঘশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। এখন আর নতুন জামার প্রতি সেই আগ্রহ নেই। তবু জীবনে ঈদ আসে, কেনাকাটা হয়। সবাই যার যার বাবা-মায়ের জন্য ঈদ শপিং করে। আমার কখনো বাবা-মায়ের জন্য ঈদ শপিং করা হয়নি। তাই ঈদ এলেই চোখ দুটো ছলছল করে।