ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিময় মায়াময় ঈদ

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ৭ এপ্রিল ২০২৪

স্মৃতিময় মায়াময়  ঈদ

.

খুব ছোটবেলায় বইতে পড়েছিলাম- ‘আজ ঈদদলে দলে লোকজন ঈদগাহে চলিলকি যে খুশির দোলা দিয়ে যেত এই দুটো লাইনআজও কথাগুলো মনের কোনে গেঁথে আছেঈদ এলেই আগে লাইন দুটো ভীষণ মনে পড়েসময় বদলেছে, সেই ঈদের আমেজ এখন আর নেইতবু এখনো চোখের কোনে সেই খুশি মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে যায়আবছা মনে পড়ে- আমিও বাবার সঙ্গে মসজিদে যেতাম ঈদের নামাজ পড়তেআমাদের সময় লেসফিতাওয়ালা আসত বাড়ি বাড়িকাপড়ে বাঁধা বিশাল একটা পুঁটলিতার মধ্যে থরে থরে সাজানো ৪/৫টা বাক্সসেগুলো ভর্তি থাকত সাজগোছের জিনিস- কোনোটায় থাকত চুড়ি, কোনোটায় মেকআপ, কোনোটায় আলতা-স্নো-পাউডারসহ অনেক কিছু! আর হাতে থাকত আরেকটা কাচের ঢাকনাওয়ালা পাতলা বাক্স সেটাতে থাকত কানের দুল, চুলের ক্লিপ, টিপসহ আরও কত কিএসেই সে ডাক দিত- লেসফিতা রাখবেন, লেসফিতা- মায়ের কাছে বায়না ধরতাম, মা লেসফিতা কিনে দাওমা সেখান থেকে ঈদের জামার সঙ্গে মিলিয়ে ফিতা, ক্লিপ, চুড়ি, লিপস্টিক, নেলপলিস, গালপলিস কিনে দিতেনব্লাশনকে বলতাম গালপলিস, সেটার নাম রোজমিষ্টি গোলাপি রঙের সেই গালপলিস দিয়ে গাল গোলাপি হয়ে যেতলিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে আর কথা বলতাম না, খেতেও চাইতাম না- লিপস্টিক মুছে যাবে তাইআজ মা নেই, লেসফিতাওয়ালাও নেইসময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু যে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা বলাই মুশকিল

বাবা ছোট একটা সরকারি চাকরি করতেনতাই মধ্যবিত্ত পরিবারে কেনাকাটার সেই জৌলুস ছিল না কখনোইবায়নাও তেমন আকাশছোঁয়া ছিল নাযা কিনে দিয়েছেন তাই মনে হতো সবচেয়ে সুন্দরথাকতাম মালিবাগেমালিবাগ বাজার তখন অনেক বড়যতদূর মনে পড়ে-বর্তমানে রেললাইনের পাশে যে বিশ্বরোড গেছে, সেই রাস্তা ছিল নাএখানেই পুরোটা ছিল বাজারসেখানে শুধু মাছ, তরকারিই থাকত না- জামা, জুতা, সাজগোছের জিনিসসহ সংসারের প্রায় সবই পাওয়া যেতবাবার হাত ধরে টুকটুক করে বাজারে যেতামতখন কুমকুম পাওয়া যেত, এক ধরনের সাজের জিনিসসেটা দিয়ে কিভাবে সাজতে হয়, তখন তা জানতাম নাএকটা কৌটার মধ্যে অনেকগুলো রংদেখতে খুব সুন্দরসাজি বা না সাজি, ওটা আমার চাইবাজারের পাশেই ছিল বিপণি বিতান, যা পরে মালিবাগ সুপার মার্কেট নামে পরিচিতি পায়এখন আর সেটাও নেই, ভেঙে ফেলা হয়েছেওখান থেকে আমাকে সুন্দর নকশা করা প্লেট, বাটি, চামচ, লবণদানি কিনে দিতে হতোঈদে আমার সব আলাদা চাইসেই প্লেট-বাটি ছিল টিনেরসুন্দর ফুল-লতা-পাতা নকশা করাআমাকে ছোট্ট একটা প্লেট কিনে দেওয়া হয়েছিলসেটার চারপাশে লতাপাতা, মাঝখানে একটা আম আঁকা ছিলআর আমের মধ্যখানে লেখা মাওটাতে আমি দীর্ঘদিন ভাত খেয়েছিঈদের জামা-জুতা কেনা হতো মৌচাক মার্কেট আর গুলিস্তান থেকেতখন টিউব মেহেদি ছিল নাগাছ থেকে মেহেদি পেড়ে বেটে চাঁদ রাতে মেহেদি দিয়ে বসে থাকতামপ্রতিযোগিতা চলত- কার মেহেদি কত বেশি রং হয়

ঈদের সকালের গোসলটা করিয়ে দিতেন বাবা বা বড় ভাইয়া, কসকো সাবান দিয়েকি সুন্দর ঘ্রাণ সেই কক্কো সাবানের (তখন কসকো সাবান বলতে পারতাম না)স্বচ্ছ, এপাশ ওপাশ দেখা যায়আজও প্রতি ঈদে আমার জন্য কক্কো সাবান বরাদ্দ থাকেতবে সেই কক্কো সাবান আর নেইসেই আনন্দও নেইগোসল শেষে মা বা আপু সাজিয়ে দিতেনমা কেন জানি চুলে চুপচুপ করে তেল দিয়ে দিতেনসেই তেলা চুলে দুইটা বেণি বা ঝুটি করে দিতেনসাজুগুজু করে সাথীদের সঙ্গে বেড়াতে বের হতামতবে কেউ সালামি দিলে নিতাম না, দৌড়ে বাসায় চলে আসতামঅন্যের থেকে টাকা নেওয়াটা খুব লজ্জার মনে হতোঅথচ সবচেয়ে মূল আকর্ষণ হচ্ছে ঈদের সালামিশুধু বাবা-মা-ভাই-বোনের কাছ থেকেই সালামি নিতামআর ঈদে বেড়াতে যেতাম পুরান ঢাকায় বড় খালার বাসায়খালার সালামির পরিমাণ ছিল বেশিসেটা নিতামতবে তখন সালামি ছিল ২ টাকা, ৫ টাকাআমি সব সময় বাবার হাতে খেতামবাবা নামাজ পড়ে এসে আমাকে নিয়ে মায়ের রান্না খাবার খেতে বসতেনতখনই আমার খাওয়া হতোসারাদিন আর খাওয়া হতো নাঈদের দিন কেন জানি ক্ষুধা অনুভব করতাম নামা কত রকম রান্না করতেনসায়েন্সল্যাব মোড়ে শিউলি স্টোরনামের দোকানটায় এখন ছেলেদের পোশাক বিক্রি হয়আমার ছোটবেলায় ওটাতে মেয়ে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করতমা ওখান থেকেই সবচেয়ে সুন্দর ফ্রকটা আমার জন্য কিনে দিতেন, টুকটুকে লাল অথবা গোলাপিনাম ছিল রানী ফ্রকসঙ্গে থাকত একই রঙের হ্যাট আর ম্যাচিং জুতা

ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ...এমন কোনো বাঙালি মুসলিম নেই এই গানের সঙ্গে যার মন নেচে ওঠে নাঈদুল ফিতর আর কবি নজরুলের এই গান যেন একে অন্যের পরিপূরকএকটু বড় হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইফতার হাতে নিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম চাঁদ দেখব বলেচাঁদ দেখতে না পেলে টিভি ছেড়ে এই গানের অপেক্ষা করতামএত বড় হয়েছি, সেই ছোটবেলার ঈদের খুশি আর সেভাবে মনকে উদ্বেলিত করে না, আপন মানুষগুলো নেই বলেতবু এই গানটি শুনলেই এখনো মনের ভেতর থেকে হাজারটা প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকেএবারও তার ব্যতিক্রম হবে না জানিছোটবেলার সেই সুখ-স্মৃতি হাতড়ে বেড়াইবাবা-মা-ভাই-বোন নিয়ে সেই পরিপূর্ণ ঈদ আনন্দ করতে ইচ্ছা করেরমজান মাস শুরু হলেই ছোট্টবেলাটা হাতছানি দিয়ে ডাকেবাড়ির ছোট মেয়ে হিসেবে আদরটা একটু বেশিই ছিলনতুন জামা কিনে লুকিয়ে রাখার কি প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল তখনকেউ দেখে ফেললে জামা পুরনো হয়ে যাবে, আমার ঈদ শেষ হয়ে যাবে

ছেলেবেলাটা সত্যিই অনেক মধুর ছিল! মনে হলেই কষ্টে ছাওয়া মনেও খুশির ঝিলিক দিয়ে যায়জীবনের সবচেয়ে করুণ ঈদ ছিল মা মারা যাওয়ার পর২০০১ সালের ১৬ রমজানে মা চলে গেলেনসেই রোজার ঈদটা ছিল সবচেয়ে বিষাদময়শূন্য ঘর! রান্নার ব্যস্ততা নেইকেউ ডেকে বলে না- তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হও, সেমাই খেয়ে মিষ্টি মুখ কর, এই যে তোমার পছন্দের কোরমা রান্না করেছিদিনশেষে রাতেও কেউ আর অভিযোগ করে না- সারাদিন কষ্ট করে এত কিছু রান্না করলাম, একটু খেয়েও দেখল নাআজও ঈদ আসেঈদ এলেই এই কথাগুলো শোনার জন্য মন ব্যাকুল হয়দিনশেষে তা একটা দীর্ঘশ্বাসে রূপান্তরিত হয়এখন আর নতুন জামার প্রতি সেই আগ্রহ নেইতবু জীবনে ঈদ আসে, কেনাকাটা হয়সবাই যার যার বাবা-মায়ের জন্য ঈদ শপিং করেআমার কখনো বাবা-মায়ের জন্য ঈদ শপিং করা হয়নিতাই ঈদ এলেই চোখ দুটো ছলছল করে

×