ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

নীলফামারীতে এনসিপি কমিটি গঠন ঘিরে তীব্র বিতর্ক: আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ন্যাপ নেতাকর্মীদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন

রিপন ইসলাম শেখ, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১৮:০৯, ২২ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৮:১০, ২২ জুন ২০২৫

নীলফামারীতে এনসিপি কমিটি গঠন ঘিরে তীব্র বিতর্ক: আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ন্যাপ নেতাকর্মীদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন

ছবি: সংগৃহীত

নীলফামারীতে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সমন্বয় কমিটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব কমিটিতে শুধু পতিত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর নেতাকর্মীদেরই নয়, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কমিটি ঘোষণার পরপরই এনসিপির একাধিক সদস্য পদত্যাগ করেছেন, যা সংগঠনটির আদর্শিক অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

বিতর্কিত কমিটি ঘোষণা: কে কোথায়

সম্প্রতি ডিমলা উপজেলা, জলঢাকা উপজেলা ও জেলা শাখার ২১ সদস্যের সমন্বয় কমিটি ঘোষণা করেছে এনসিপি। কমিটিগুলোর বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ নিয়েই মূলত বিতর্ক শুরু হয়েছে।

স্থানীয়দের মতে, একটি অরাজনৈতিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠনে দলীয় প্রভাব বিস্তারের এ প্রবণতা অপ্রত্যাশিত এবং আদর্শের পরিপন্থী।

ডিমলা উপজেলা কমিটিতে প্রধান সমন্বয়কারী করা হয়েছে জাতীয় পার্টির সক্রিয় নেতা মোশারফ হোসেন মিন্টুকে। একই কমিটিতে রয়েছেন আওয়ামীপন্থী জাতীয় পার্টির সাবেক উপজেলা সভাপতি ও বর্তমান ন্যাপ সভাপতি জাকারিয়া হোসেন রাজু, এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সদস্য রবিউল ইসলাম শুকারু।

জেলা কমিটিতে প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে আছেন আব্দুল মজিদ, যিনি ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এছাড়া জেলা কমিটির ৩ নম্বর সদস্য শামসুল হক শাহ, যিনি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট, তিনিও কমিটিতে রয়েছেন।

আলোচনায় আল আমিন ইসলাম ও জলঢাকার বিতর্কিত সদস্যরা

সর্বাধিক সমালোচিত নাম হলো আল আমিন ইসলাম, যাকে জেলা কমিটির ৭ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। তিনি জেলা তাঁতী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি আন্দোলনকারীদের ভিডিও ধারণ করে প্রশাসনের হাতে তুলে দেন।

জলঢাকা উপজেলা কমিটিতেও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নাম পাওয়া গেছে। সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার ঘনিষ্ঠ রেজাউল করিম রাজু ও শরীফুজ্জামান শরীফ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন।

আদর্শচ্যুতি ও পদত্যাগের হুমকি

জাতীয় নাগরিক পার্টির মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বর্তমান কমিটির গঠন ও বিতর্কিতদের অন্তর্ভুক্তি সেই লক্ষ্য ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অনেকেই।

জেলা কমিটির ২ নম্বর সদস্য আক্তারুজ্জামান অভিযোগ করে বলেন, “এই কমিটিতে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থ ও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত, মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রমোট করা হচ্ছে। এজন্য আমি অতিদ্রুত পদত্যাগ করব।”

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈষম্যবিরোধী নেত্রী বলেন, “যদি একটি জনকল্যাণমুখী সংগঠনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী ও অপরাধে অভিযুক্তদের স্থান দেওয়া হয়, তাহলে জনগণ এনসিপিকে আর বিশ্বাস করবে না।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ, আহ্বান পুনর্গঠনের

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা লাভলী আক্তার খুশি ফেসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাসে বলেন, “এইলা কোনো কথা বাহে, একাম বাদ দিলেন ক্যানে তোমা? সবাই মিললা, ঝিললা চলির নাগে বাহে।”

তিনি উল্লেখ করেন, সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা, আফতাব উদ্দিন, ফারজানা আক্তার সুমি, আনোয়ারুল হক সরকার মিন্টু, তবিবুল ইসলাম ও ফেরদৌস পারভেজ প্রভাবশালী হলেও এদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে দলটির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

ওয়ারিয়র্স অব জুলাই-র নীলফামারী জেলা আহ্বায়ক সাইমুন সাকিব বলেন, “ফ্যাসিস্টদের দোসররা কমিটিতে স্থান পেয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিকে অনুরোধ করছি দ্রুত এদের সরিয়ে দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠন করা হোক।”

কেন্দ্রীয় নীরবতা ও আশঙ্কার দোলাচল

এত সমালোচনার পরও এখনও পর্যন্ত এনসিপির কেন্দ্রীয় বা জেলা পর্যায় থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। স্থানীয় পর্যায়ে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কারণে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সংগঠনটি জন্মলগ্ন থেকেই গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

আসিফ

×