ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনা

কর্নেল মাসুদ পারভেজ চৌধুরী, পিএসসি

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনা

বর্তমান পৃথিবীতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন

কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেললাইন প্রকল্পের কাজ শেষ। গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ তিন লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের কাজ চলছে। এই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে

বর্তমান পৃথিবীতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন। পর্যটন শিল্প বহুদেশেরই অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিয়েছে। এমনকি বিভিন্ন দেশের মূল অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিই এই পর্যটন। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পর্যটনকে ঘিরে বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য ও একক বৈশিষ্ট্যম-িত হওয়ায় পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। যার মধ্যে আশার হাতছানি দিচ্ছে কক্সবাজার।

কক্সবাজার বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি অপার সম্ভাবনাময়ী জেলা। চট্টগ্রাম বিভাগের এই জেলাকে দেশের একটি মৎস্য ও অন্যতম পর্যটন শহরও বলা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত এই কক্সবাজারে অবস্থিত, যা ১২০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। সৈকতের পাশাপাশি বন-উপবন, খাল-নদী, ঝিরি-ঝরনা, বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ জেলা একসময় পালঙ্কি বা প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল।

মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এই কক্সবাজারে রয়েছে সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনও। সৈকতের তীরে বেসরকারী হোটেল-মোটেল ছাড়াও রয়েছে পর্যটন মোটেল। সম্প্রতি গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পাঁচ তারকা মানের হোটেলও। এক কথায় বলা চলে দেশের সবচেয়ে আকর্ষিক পর্যটন স্পট এখন এই কক্সবাজার। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেতে তাই সময় পেলেই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ছুটে আসেন কক্সবাজারে। বিশ্ব যখন ভ্রমণকে আলিঙ্গন করতে শুরু করেছে, তখন কক্সবাজার পর্যটকদের জন্য একটি উপযুক্ত স্পট হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
কক্সবাজার সৈকতে গেলে দেখা যায় এক অপরূপ মনোরম দৃশ্য। আনন্দ উল্লাসে মুখরিত সাগর তীর। ইনানী পাথরের সৈকত, মহেশখালী আদিনাথ মন্দির, হিমছড়ি ঝরনা, ডুলাহাজারা সাফারিপার্কসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে বছরজুড়ে লেগেই থাকে পর্যটকদের ভিড়। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক’ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ, মহেশখালী ট্যুরিজম পার্ক প্রকল্প, টেকনাফের সাবরাং এলাকায় ১২০০ একর জমিতে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল প্রকল্প, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ, এবিসি সড়ক সম্প্রসারণ, কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটে ব্রিজ প্রকল্প, দোহাজারী-ঘুমধুম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, কক্সবাজারে পর্যটনের উন্নয়নে পর্যটন কর্পোরেশনের মালিকাধীন মোটেল শৈবালের ১২৫ একর জমিতে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন জোন বাস্তবায়ন, একই সঙ্গে মোটেল প্রবালের ৬ একর জমিতে পর্যটন বিষয়ক একটি ইনস্টিটিউট তৈরি করার পরিকল্পনা।

সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার হবে একটি আদর্শ পর্যটন শহর। যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। আর এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’। পর্যটকদের সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার গঠন করেছে টুরিস্ট পুলিশ। পর্যটনকে বিকশিত করার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়মাত্র। দ্রুত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে এবং প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কক্সবজারে। যা বেকারত্ব হ্রাসে রাখবে ব্যাপক ভূমিকা।
কক্সবাজার হলো অবিরাম প্রবাল সমুদ্রসৈকতের অনন্য সৃষ্টি। বঙ্গোপসাগর দ্বারা আচ্ছন্ন সোনালি বালির অবিরাম প্রসারিত এই সৈকত স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। শহুরে জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে প্রশান্তি দেয়। যেখানে মন্ত্রমুগ্ধ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্যগুলো জাদুকরের জাদুর চেয়ে কম নয়। সৈকতটি সার্ফিং, জেট-স্কিইং এবং প্যারাসেইলিংসহ বিভিন্ন জলক্রীড়ার জন্য উপযুক্ত স্থান।

কক্সবাজারের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে ঐতিহাসিক বদর মোকাম মসজিদ, ঝাউবীথি, প্যারাবন, বার্মিজ মার্কেট, শুঁটকির আড়ৎ নাজিরারটেক, রাডার স্টেশন, হিলটপ সার্কিট হাউস, লাইট হাউস, অমেধা ক্যাং, জাদি, রাখাইন পল্লী, মোঘল আমলের প্রাচীন মসজিদ, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, রাবার ড্যাম, ইন্টারন্যাশনাল এমিউজমেন্ট পার্ক, শিশু পার্ক (চলমান), আন্তর্জাতিক ফুটবল কমপ্লেক্স (চলমান), বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি, দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্র, হিমছড়ি, ঝরনা, ইনানী, গাজীর টেক, পাটোয়ার টেক, বাহারছড়া, পাহাড় ও সমুদ্র, কক্সবাজার-টেকনাফ দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ, শাহপরীর গার্ডেন, ঘুমধুম কুমির চাষ প্রকল্প, টেকনাফ গেম রিজার্ভ বা ন্যাচার পার্ক, খুরুস্কুল স্মার্ট সিটি, থিম পার্ক, ইকো রিসোর্ট, চৌফলদ-ী রিভাররেইন ট্যুরিজম, কউকের দৃষ্টি নন্দন পুকুর, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, লামারপাড়া ক্যাং, রামু রামকোর্ট বৌদ্ধ মন্দির, তীর্থ ধাম, আইসোলেটেড নারিকেল বাগান, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনাকেন্দ্র, রামু রাবার বাগান, রামু চা-বাগান, দেশের একমাত্র পাহাড়বিশিষ্ট দ্বীপ মহেশখালীর আদিনাথ শিব মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, মহেশখালীতে দেশের বিখ্যাত পানের বরজ, ৯০ ভাগ রপ্তানিকারক লবণের ফ্যাক্টরি, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, খুটাখালী মেদাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক, মগনামা ঘাট, দেশের একমাত্র বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাতি ঘর, মালেক শাহের দরবার শরীফ, সোনাদিয়া দ্বীপ, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হেলিকপ্টারে জয় রাইড, প্যারাসাইলিং রাইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ইতোমধ্যে কক্সবাজারের পর্যটন বিকাশ এবং গভীর সমুদ্র বন্দরভিত্তিক বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগও গড়ে তোলা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এসেছে রেল যোগাযোগের মাধ্যমে। এতে পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি কক্সবাজারকে সিঙ্গাপুর, হংকংসহ দ্বীপভিত্তিক অর্থনৈতিক হাবের আদলে গড়ে তোলার জন্য সরকার বাস্তবায়ন করছে মহাপরিকল্পনা।
শুধু যোগাযোগ অবকাঠামো নয়, দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর- কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ী-মহেশখালীতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। জাপানের অর্থনীতি ও সৌন্দর্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখা কাশিমা বন্দরের আদলে নির্মিত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরটি বাংলাদেশের প্রধান আমদানিকারক চীনসহ বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যের নতুন নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই সমুদ্র নগরীতে প্রতিবছর ৬০-৭০ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে গেলেও বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা খুব কম। এদেশে বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম করা হচ্ছে। টেকনাফের সাবরাং, নাফ ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ সাজানো হচ্ছে। 
১৯৬২ সালে যখন কাশিমা বন্দর নির্মাণ শুরু হয়, তখন এলাকাটি ছিল ধানক্ষেত।

বন্দর নির্মাণের পর এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরও এ ধরনের বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে থাকবে পাঁচ তারকা হোটেল, ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম ও সী-ত্রুজ, বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, সাগরম-ল, পানির নিচে রেস্তোরাঁ, ভাসমান রেস্তোরাঁ ইত্যাদি বিনোদনের বিভিন্ন সুবিধা।

এছাড়াও টেকনাফ শহরের কাছে নাফ নদীর মোহনায় জালিয়ার দ্বীপকে ঘিরে নাফ ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ চলছে। মূলত বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এই পার্কে ইকো কটেজ, লাইফ এন্টারটেইনমেন্ট থিয়েটার, মেগা শপিংমল, সিনেমা হল, গল্ফ ক্লাব, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডের মতো ওয়াটার স্পোর্টস বিচসহ নানা আয়োজন থাকবে।
কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেললাইন প্রকল্পের কাজ শেষ। গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ তিন লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের কাজ চলছে। এই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে।
সারাদেশে যোগাযোগব্যবস্থা ও অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন বিকাশে যেসব মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তার অনন্য উদাহরণ কক্সবাজার। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে নতুন করে যে কটি প্রকল্প আশার প্রদীপ হিসেবে ধরা হয়, এর মধ্যে অন্যতম ‘সাবরাং ট্যুরিজম অর্থনৈতিক অঞ্চল’। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকনাফ সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নকাজ উদ্বোধন করেন।

টেকনাফের অর্থনৈতিক অঞ্চল সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক জোনে ১ হাজার ১৬৫ একর জমি রয়েছে। সুদীর্ঘ বালুকাময় সৈকত আর সাগর-পাহাড়ের অপূর্ব মিলন আর বৈচিত্র্যময় দৃশ্য এ স্থানকে পরিণত করেছে সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটি বিনোদনপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

এটি বাস্তবায়ন হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছে বাস্তবায়ন সংস্থা বেজা কর্তৃপক্ষ। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটিতে পাঁচতারকা হোটেল, ইকো ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম, বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশুপার্ক, ইকো কটেজ, ওশানেরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা বিনোদনের সুবিধা রাখা হবে। এছাড়া টেকনাফে নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এর অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের বাইরে, কক্সবাজার একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবাসস্থল। এলাকাটিতে বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে এবং তারা এ অঞ্চলের অনন্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অবদান রাখে। ইকো ট্যুরিজমের ফলে পর্যটকদের স্থানীয় গ্রামগুলো অন্বেষণ, বন্ধুত্বপূর্ণ স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ঐতিহ্যগত রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলো অনুভব করার সুযোগ রয়েছে। প্রাণবন্ত বাজার এবং রঙিন উৎসব কক্সবাজারের মানুষের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য বহন করে।
কক্সবাজার শুধু রোদ আর বালি নয়; এটি পরিবেশ-সচেতন ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল। হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান কক্সবাজারের কাছে অবস্থিত। লীলাভূমি, বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী এবং হাইকিং ট্রেইলগুলো অন্বেষণ করার সুযোগ রয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য। পার্কগুলো হাতি, চিতাবাঘ এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির জন্য একটি অভয়ারণ্য। ইকোট্যুরিজম জড়িত হওয়ায় এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে আরও উৎসাহিত করে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে। 
কক্সবাজারে ইকোট্যুরিজমের ব্যাপক প্রসারে পরিবেশবান্ধব আবাসন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, পর্যটনভিত্তিক স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পর্যটকদের কাছে স্থানীয় সংস্কৃতি তুলে ধরতে সেখানকার হোটলেগুলোতে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, গহনার প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

তৈরি হবে আয়ের উৎস। কমিউনিটি হোম স্টোর উদ্যোগ স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা ইকোট্যুরিজমের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব। 
কক্সবাজারকে একটি সুপরিকল্পিত পর্যটন শহর হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। কক্সবাজারের অন্তর্গত সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ও সংকটপূর্ণ এলাকা হওয়ায় ২০২৩ সালের মে মাসে সরকার এ দ্বীপ রক্ষার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর আওতায় দ্বীপের জমি, ভূমি উন্নয়ন ও অবকাঠামো (যেমন- রেস্টহাউস, ডরমিটরি, হোস্টেল) নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য, পর্যটনসংক্রান্ত বিষয় এবং পরিবহন ব্যবস্থাপনায় মুখ্য ও সহযোগী বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিনির্দেশপূর্বক একটি নির্দেশিকা জারি করেছে।

তবে ইকোট্যুরিজম বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এখনো যথেষ্ট জনসচেতনতা গড়ে ওঠেনি। ইকোট্যুরিজমের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। তবে সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত কক্সবাজারকে একটি টেকসই ও আধুনিক পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ইতোমধ্যে সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে পৌঁছে গেছে রেল। যার ফলে কক্সবাজারের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। শেষ গন্তব্যস্থল কক্সবাজার রেলস্টেশনে আবাসনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত লকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর ফলে সেখানে বেড়াতে যাওয়া রেলযাত্রীরা তাদের লাগেজ নিরাপদে রাখতে পারবেন।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, হিমছড়ি সমুদ্রসৈকত ও বন্যপ্রাণী পার্ক, ইনানী সমুদ্রসৈকত, মহেশখালী এবং সোনাদিয়া দ্বীপে নির্বিঘ্নে সময় কাটাতে পারবেন। রেললাইন সম্প্রসারণের ফলে ভ্রমণ তুলনামূলক আরামপ্রদ, ব্যয়সাশ্রয়ী, নিরাপদ হওয়ায় এ নগরীতে পর্যটকদের পদচারণা বৃদ্ধি পাবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)

×