আগস্টের কিছু কিছু তারিখে আমাদের উৎসবে মাতার কথা ছিল। অথচ পনেরো আগস্ট সামনে রেখে উল্টো প্রচণ্ড ব্যথায় শোকে নীল সেই দিনগুলো। এমনি প্রথম তারিখটা ৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্মদিন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা কিছু মানুষকে ইতিহাসে ঘায়েল করার জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যয় করে জাতির সামনে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালানো হয়। তাদের তালিকার একেবারে ওপর দিকে শেখ কামালের নামটি। পরিকল্পিতভাবে নানা অপপ্রচারে নাম জুড়ে দিয়ে অন্যায় ব্র্যান্ডিংয়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল তাকে। বাংলাদেশ তো বটেই এটি আমাদের এই অঞ্চলেও নজিরবিহীন।
নব্বই দশকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। তখন ভাবিনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ টানা একযুগেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবে। যুগের পর যুগ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে যোজন-যোজন দূরে থাকার অমোঘ নিয়তিকে মেনে নিয়েই সেই সময় তরুণরা শুধু আবেগ আর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধরত। ‘শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির’ মূলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে যোগ দিত ছাত্রলীগের মিছিলে। সেই তরুণরাই পরবর্তী সময় হাল ধরেছে মূল এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও সেই ছাত্রলীগের সোনালি অর্জন।
মধ্য বয়সে এসে যৌবনে ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে অবাক হই যে এত দমন-পীড়ন আর প্রতিক‚লতার মুখেও একটি ছাত্র সংগঠন শুধু টিকেই থাকেনি, নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রতিটি বড় আন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সময়ে দেশ আর দেশের মানুষের পাশে থেকেছে বুক চিতিয়ে, ঢেলেছে বুকের রক্ত। ছাত্রলীগ তার সংগ্রাম আর বিকাশের একেকটি পর্যায়ে অনেক অসম্ভব মেধাবী সংগঠকের ছোঁয়া পেয়েছে। তাদের অনুপস্থিতিতে সেই সোনালি ছোঁয়ার অনুরণন রয়ে গেছে বহুযুগ ধরে। তাদের মধ্যে যে নামটি সবচেয়ে জ্বলজ্বলে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার হাতে গড়া এই ছাত্রলীগ। একইভাবে আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ কামাল। এই গুণী সংগঠক ছাত্র রাজনীতির জন্য নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন। বিশাল কোন পদধারী না হয়েও হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রলীগের মূল চালিকাশক্তি।
অসম্ভব মেধাবী এই সংগঠক নানাভাবে তরুণদের সংগঠিত করে এদেশের তরুণদের সামনের দিগন্তকে আদিগন্ত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। একাধারে যেমন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মতো স্পোর্টস ক্লাবের স্বপ্নদ্রষ্টা, তেমনি ঢাকার সে সময়কার ঐতিহ্যবাহী ইস্টএন্ড এবং কামাল স্পোর্টিং ক্লাবও তার সাংগঠনিক ছোঁয়ায় বিকশিত হয়েছিল। বাংলাদেশে মেশিনে তৈরি আধুনিক ফুটবল, আধুনিক জার্সি এবং স্পোর্টস স্যু পরে আধুনিক ফুটবলের সূচনা আবাহনীর মাধ্যমে শেখ কামালই করেছিলেন। তিনিই ইস্টএন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন পুরনো ঢাকার তরুণ আর প্রভাবশালীদের। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা জেলা পরিষদের অডিটরিয়ামে প্রথম মঞ্চ নাটক মঞ্চায়নের পেছনেও ছিলেন শেখ কামাল। একদিকে তিনি বিটিভিতে প্রথম সিরিজ নাটকের উদ্যোক্তা এবং অভিনয় শিল্পী, অন্যদিক তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু এদেশের প্রথম ব্যান্ডসঙ্গীতের।
শেখ কামাল শুধু রাজনীতি, খেলাধুলা এবং শিল্প-সংস্কৃতির জগতেই প্রতিভার ঝলক দেখাননি, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশনপ্রাপ্ত চৌকস সেনা কর্মকর্তা। ভারতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের তরুণ অফিসারদের প্রশিক্ষণকালে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। সারাদিন কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে অফিসার্স মেসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে সহকর্মীদের মাতিয়ে রাখতেন। সেনাবাহিনীর কমিশনেও এই মেধাবী তরুণটি মেধাক্রমে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যমণি ছিলেন শেখ কামাল। একদিন অবলীলায় এই তরুণ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে। শেখ কামাল সেদিন সেই সিদ্ধান্তটি না নিলে হয়তো ১৫ আগস্ট সংগঠিত হতো না। প্রথমত তার উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে এমন চক্রান্ত করার সাহস কেউ দেখাত না। দ্বিতীয়ত সাহস দেখালেও বিষয়টি কখনই তার অজ্ঞাত থাকত না।
করোনায় জর্জরিত গোটা পৃথিবী একই সঙ্গে বাংলাদেশ। পৃথিবীর শতাধিক দেশে যখন ভ্যাকসিন এখনও সোনার হরিণ তখন আমাদের ভ্যাকসিন যাচ্ছে গ্রামে। নিজেরা উৎপাদন না করেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক কৃতিত্বে শুরু হচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে গণভ্যাকসিনেশন। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ ভ্যাকসিন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা। শুধু প্রশাসনের ওপর নির্ভর না করে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করতে। বেদনায় নীল শেখ কামালের আরও একটি জন্মদিনে এই স্বপ্নচারী ছাত্র সংগঠককে জাতির বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। আজ তিনি তার প্রিয় বড় বোনের পাশে থাকতে পারলে এই মহামারীকে হারানোর যুদ্ধে আমরা আরও অনেক বেশি এগিয়ে থাকতাম। শেখ কামাল নেই কিন্তু তার আদর্শে অনুপ্রাণিত অনুজরাই প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে ভ্যাকসিনযজ্ঞটিকে সফল করবেন।
লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব,
সম্প্রীতি বাংলাদেশ