ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত

সামর্থ্য নয়, ভিন্ন সামর্থ্য

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১২ মে ২০১৯

 সামর্থ্য নয়, ভিন্ন সামর্থ্য

অনুপমা চক্রবর্তী ॥ বৈচিত্র্যময় উপাদানে গঠিত আমাদের এই মানব সমাজ। যেখানে বসবাসরত মানুষের মধ্যে পৃথক পৃথক সত্ত্বা বিদ্যমান। এখানে অভ্যন্তরীণ গুণাগুণ, দোষ-ত্রুটি ছাড়িয়ে বাহ্যিকতায় পরিলক্ষিত হয় ভিন্নতা। কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ ফর্সা আবার কেউবা কালো। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অনেকেই আছে যাদের কারোর হাত বা পা নেই অথবা দৃষ্টিশক্তিহীন কিংবা বধির। সমাজে যাদেরকে দেখা হয় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। মানুষের এরূপ শারীরিক বা মানসিক অসঙ্গতির কারণে উদ্ভূত সীমাবদ্ধতা যা স্বাভাবিক কার্যক্রমকে আংশিক বা সামগ্রিকভাবে ব্যাহত করে, তাকে জাতিসংঘ সংজ্ঞায়িত করে প্রতিবন্ধিতা বলে। সুতরাং, কতিপয় প্রতিবন্ধকতার কারণে কোন ব্যক্তি যদি সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব ও কাঠামোগত অসামর্থ্যরে শিকার হয়ে প্রাত্যহিক জীবন যাপনে বাধার সম্মুখীন হয় তাহলে তাকে প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই প্রতিবন্ধিতা কিন্তু একটি সার্বজনীন বিষয় যেখানে অনেকেই কমবেশি এক কঠিন বাস্তবতার জীবন্ত সাক্ষী। কেননা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হয়তো আমাদের নিকট অথবা দূরবর্তী কোন পরিবারে বেড়ে উঠছে কোন না কোন প্রতিবন্ধী। তারা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছে; আমাদের চলমান সামাজিক অবকাঠামো এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই যার প্রধান কারণ। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও প্রতিবন্ধিত্বকে আমাদের সমাজে একটি অভিশাপস্বরূপ বা পাপ কাজের শাস্তি বলে মানা হয়। এরূপ মনোভাব প্রতিবন্ধীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ যত্ন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা এবং অংশগ্রহণের সুযোগকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, নানা বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অনেক সময় এদের প্রতি অনেকের ভাবখানা এমন হয়, যেন এরা ভিন্ন জগতের প্রাণী। এমনকি আত্মীয়স্বজন এবং সামাজিক মানমর্যাদার ভয়ে পারিবারিকভাবে লুকিয়ে রাখা হয় তাদের। ফলে শিশুকাল থেকে অবাধ চলাফেরায় বঞ্চিত হয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিয়ে প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে বৈষম্যের শিকার এসব প্রতিবন্ধী আর নিজেদের সমাজে সম্পৃক্ত করতে পারে না। তারা হয়ে যায় পরিবারের বোঝা। অথচ শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে বিশ্ব। যার উপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন অনুসারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায় প্রতিবন্ধিতার ধরণ নির্ধারিত হয়। যার বিবেচনায় এদেরকে সাধারণভাবে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতায় শ্রেণীভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ একজন প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যাবতীয় অধিকারের বিধান প্রণীত এ আইনে। এখন শুধু মানবাধিকার ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নের ধারায় পরিচালিত করার আপ্রাণ প্রয়াস। যার জন্য ব্যক্তি এবং সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত আবশ্যক। একটি সুস্থ ব্যক্তির অসুস্থতা, দুর্ঘটনা অথবা অন্য যে কোন কারণে যে কোন সময় প্রতিবন্ধিতার ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে। তাই প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে একমাত্র পারিবারিক সচেতনতাই পারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে। এই প্রতিবন্ধিদের প্রতিবন্ধকতা যেমনই হোক ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের বিভেদ ভুলে তাদের সহযোগিতায় সমষ্টিগতভাবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আর যেহেতু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিপুলসংখ্যক শিশু অটিজম নামের এই নিউরো-ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত সেহেতু প্রতিবন্ধীবান্ধব সচেতনতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের আবশ্যিক দায়িত্ব। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জাতিকে পরিয়েছে সভ্যতার জয়মাল্য। সেক্ষেত্রে স্টিফেন হকিং, জন ন্যাস, ক্রিস্টি ব্রাউন, ডেমোস্থিনিস, ফ্রিডা কাহলো, হেলেন কেলার, সুধা চন্দ্রন, লুইস ব্রেইল, স্টিভ ওন্ডার প্রমুখ ব্যক্তিদের কথা না বললেই নয়। সুতরাং, আমাদের আশপাশেও হয়তো এমন সব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন অনেকেই রয়েছে যারা সামান্য সহানুভূতি ও সহযোগিতায় হয়ে উঠবে মহামানব। আসুন প্রতিবন্ধীদের পাশে থাকি, প্রতিবন্ধকতামুক্ত উন্নত দেশ গড়ি। লেখক : গবেষক
×