ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মহাকাশে ‘সাহসিনী’র বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৩ মে ২০১৮

মহাকাশে ‘সাহসিনী’র বাংলাদেশ

১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় ভারতের ‘আর্যভট্ট’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে এই উপমহাদেশের কোন দেশের প্রথম মহাকাশে প্রবেশের সুযোগ ঘটে। চীনের সহায়তায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যে নিজেদের উপগ্রহ ব্যবস্থায় নাম লেখালেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যতিক্রম; যে নিজের উদ্যোগে ও নিজের আর্থিক ভরসা ও দায়িত্বে মহাকাশে প্রবেশে নাম লিখিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ইতোমধ্যে সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে যা বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। সদ্য মধ্যম আয়ের দেশে নাম লেখানোর অনেক আগেই বাংলাদেশ যখন পরিকল্পনা করে এই প্রকল্প হাতে নেয় তখন বিশ্বসভায় উন্নত বিশ্বের অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে। প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হিসেবে বিটিআরসি যখন ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাছে পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ১০২ ডিগ্রী ও (পরে ১৩৩, ৬৯ ও ৭৪ ডিগ্রী) কক্ষপথের জন্যে আবেদন করে তখন চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ আইটিইউ’র সদস্য মোট ২০টি দেশ এতে আপত্তি জানায়। যদিও বাংলাদেশ আইটিইউ’র নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্য। কিন্তু অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে আইটিইউর নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থেকেও বাংলাদেশ সেসব দেশের অনাপত্তির মীমাংসা এখন পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে এখনকার কক্ষপথ ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ভাড়া নিয়ে তার আরাধ্য স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্যে তার উন্নয়নের পথপরিক্রমা বিশেষ মসৃণ কখনই ছিল না। স্বাধীনতার পরে একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশ সামলে নিয়ে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুকেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু সেকালের সব শক্তিমান আর কুচক্রী মহলের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করেই নিজেদের টাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল পরিত্যক্ত বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু এটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু এ রকম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও নিজেদের সক্ষমতায় মহাকাশ সম্পদ আহরণের কাজকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নিয়েছেন তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী সাহসিনী শেখ হাসিনা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই উদ্যোগ তাই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েই মহাকালে থেকে যাবে। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট জগতে নিজের অধিকার পেয়েছিল ভারতের নেতৃত্বে ৫ মে ২০১৭ তারিখে ৯৭.৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশে পাঠানো ‘সার্ক’ স্যাটেলাইটের ৩৬ মেগাহার্টজের একটি ট্রান্সপন্ডার (ট্রান্সপন্ডার হলো উপগ্রহের ইন্টারকানেক্টেড ইউনিটগুলোর সিরিজ যা সঙ্কেত পেতে ও পাঠাতে এ্যান্টেনার মধ্যে একটি যোগাযোগ চ্যানেল তৈরি করে) ব্যবহারের মাধ্যমে। পাকিস্তান ছাড়া সার্কভুক্ত আর সব দেশ (বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা) এতে অংশ নিয়েছে সমান একটি করে ট্রান্সপন্ডার নিজেদের অধিকারে ব্যবহারের। নেপাল নিজেদের উপগ্রহ বিচরণ সুবিধার জন্যে পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ৫০ ডিগ্রী ও ১২৩.৩ ডিগ্রী কক্ষপথ আইটিইউর কাছ থেকে বরাদ্দ পেলেও নিজেদের স্যাটেলাইট এখনও উৎক্ষেপণের আয়োজন শেষ করতে পারেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধ অগ্নিপরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান হলো আইটিইউর কাছ থেকে কাক্সিক্ষত কক্ষপথ না পেয়েও সে বিকল্প পথে হলেও তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ও নিজেদের উপগ্রহ সফলভাবে পাঠিয়ে ছেড়েছে। ১৯৬৭ সালে সংগঠিত জাতিসংঘের আউটার স্পেস ট্রিটি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে বহির্বিশ্ব গবেষণার ও সুবিধা গ্রহণের সুযোগ সকল দেশের জন্যে মুক্ত ও স্ব-স্ব দেশকে এর দায়িত্ব নিয়েই কাজ করতে হবে। জাতিসংঘেরই অপর সংস্থা আইটিইউ; যার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক রীতিকে অক্ষুণœ রাখা তার গঠনতন্ত্রের ৪৪ ধারায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছেÑ সকল সদস্য দেশের বহির্বিশ্বে অধিগমনের সমান অধিকার নিশ্চিত থাকবে। সে অনুসারে আইটিইউ কক্ষপথের বরাদ্দে বাংলাদেশের সঙ্গে তার অপরাপর দেশের আপত্তির মীমাংসা নিজ উদ্যোগেই সম্পন্ন হবার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে অধিকার কিছুটা হলেও সে ক্ষুণœ করেছে। এখন বাংলাদেশ সাহস করে যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে সেখান থেকে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে সে আরও উজ্জ্বল করে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার অধিকার করেছে যার অর্ধেক অন্যের কাছে বাংলাদেশ সরকার ভাড়া দেবে বলে পরিকল্পনা রেখেছে। বাংলাদেশ যদি ২০টি ট্রান্সপন্ডারও নিজের আয়ত্তে রেখে ব্যবহার করে তার সুদূরপ্রসারী সাহসী পরিকল্পনাও এখন ঠিক করে নিতে হবে। অনেকেই ভাবছেন, আমাদের ডিশ টেলিভশন দেখার সুযোগ এখন বাড়বে। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু–১ স্যাটেলাইট একটি ব্রডকাস্ট ও কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। কিন্তু তার সুযোগ বিনোদনের চাইতে সেবাকাজে ও গবেষণায় ব্যবহার যেন বেশি হয় সে ভাবনা আমাদের রাখা জরুরী। উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে হলেও আমাদের দ্বিতীয়-তৃতীয় স্যাটেলাইটের অগ্রিম প্রস্তুতি রাখতে হবে। তার জন্যে বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে বিজ্ঞান গবেষণায় যে ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বর্তমান সরকার বা এই সরকারের নেতৃত্ব যা করে দেবার তা সাহস করে করেছেন যা আমাদের মতো মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোর জন্যে এটি একটি বিরল উদাহরণ। কিন্তু তারা জন্য পরবর্তী কাজ অব্যাহত রাখতে একটি সমন্বিত চিন্তা দরকার। এ রকম বিজ্ঞান কেমন করে আমাদের দারিদ্র্য মোচনে ভূমিকা রাখবে, আমাদের শিক্ষায় বা আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কেমন করে নতুন উদ্ভাবন করে পৃথিবীকে চমকে দেবে সেই চিন্তা এখন আমাদের করতে হবে। ফলে সামাজিক সেক্টরে আমাদের বিজ্ঞানের ব্যবহার যখন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছবে তখন আমাদের কক্ষপথ পেতে কেউ বাধা দেবার চিন্তাই করতে পারবে না। শুধু কক্ষপথ পেতে কেন, আমাদের দেশের তরুণদের আবিষ্কারের নেশায় সেসব দেশের কূটনীতিকদের মাথাও তখন নুয়ে আসবে। লেখন: পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প ই-মেইলঃ [email protected]
×