ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ -মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ -মোস্তাফা জব্বার

॥ এক ॥ বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৮তম জন্মদিনটি এবার আমরা পার করলাম। বরাবরের মতোই বাঙালী তার এই বিজয়ের দিনটিকে অনন্য সাধারণ করে তোলার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। এর মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করলাম। বিজয় অর্জন করার মাত্র দু’দিন আগে আলবদর, রাজাকাররা আমাদের দেশের মেধাবীদের যেভাবে হত্যা করেছিল তা আমরা এমনভাবে পালন করেছি যাতে মনেই হবে যে এরই মাঝে আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছি। তবে বিজয় অর্জনের এত বছর পরও কি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমরা সকল শহীদকে সেই সম্মান দিতে পেরেছি যা আমাদের দেয়া উচিত ছিল। শহীদদের তালিকায় বুদ্ধিজীবীরাই থাকুক বা মুক্তিযোদ্ধাই থাকুক কিংবা অতি সাধারণ মানুষ যারা গণহত্যার শিকার হয়েছিল তাদের প্রতি কি আমরা সেই সম্মান দিতে পারছি যা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। দুঃখজনকভাবে এটিও সত্য যে, আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের সেই শহীদদের চেনে কিনা- জানে কিনা বা আমরা তাদের শহীদদের কথা বলি কিনা। মাত্র ক’দিন আগে, ৯ নবেম্বর ১৭ আমার প্রিয় মানুষদের একজন বাসদ নেতা আ ফ ম মাহবুবুল হক চলে গেলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটিকে দেশে আনা হলো না। আমার জানা মতে তাকে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রও দেয়া হয়নি। মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কানাডার মাটিতে শুয়ে থাকতে হলো। এর ফলে তার সহযোদ্ধারা বা দেশের মানুষ তার কবরও জিয়ারত করতে পারবে না। আমি তাকে সেই ’৬৮ সাল থেকে দেখে এটা নিশ্চিত জানি যে, এই দেশের কোন সুযোগ-সুবিধা তিনি কোনদিন কোন আকারে গ্রহণ করেননি। দেশ তাকে কোন প্রতিদান না দিক অন্তত সম্মানটা তো তার প্রাপ্য। কিন্তু সেটি আমরা দিতে পারিনি। ’৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলে প্রবেশ করার পর থেকে যতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন ততদিনই একেবারে বড় ভাই বা অভিভাবকের মতো মাথার ওপরে ছিলেন। সেই মানুষটি অপঘাতে প্রাণ হারালেনÑ তার বিচারও হলো না। সেই কষ্টটা এখনও সামলাতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মাহবুব ভাইয়ের কাছে এত ঋণী যে, এই অপারগতার দায় থেকে নিজেকে কোনভাবেই মুক্ত করতে পারছি না। আমার নিজের কষ্ট লাগে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ভরে যায় আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কেউ কোন খবর রাখে না। এটি নিশ্চিত যে, কোন মুক্তিযোদ্ধাই সনদ ও ভাতার জন্য যুদ্ধ করেননি। কিন্তু রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে তাকে স্বীকৃতি প্রদান করা। অথচ রাষ্ট্র আমার মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতিই দেয়নি। আরও অনেক দায় থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। এক বছর আগে ১৬ সালের ১৬ নবেম্বর চলে গেল মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু শেখ আবদুল কাইয়ূম। ওর জন্যও কিছুই করতে পারিনি। যতবার ওর মেয়ে ফারজানার সঙ্গে ওর ছবি দেখি ততবারই মনে হয় আমরা বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যা আমাদের করা উচিত। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আফতাব আহমদকে গুলি করে হত্যা করা হলো তারও কোন বিচার এখনও হয়নি। এদের কারও কারও সঙ্গে আমি রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। আফতাব তো এক সময়ে আমাদের ভাবনার বিপরীত রাজনীতি করেছে। মাহবুব ভাই বিপরীত রাজনীতি করেননি- তবে তার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। কোনভাবেই কোন মুক্তিযোদ্ধার অপঘাতে মৃত্যু আমি বিচারহীনভাবে পার করাটা সমর্থন করি না। আমার নিজের কাছে এটিকে একটি দায় বলে মনে হয়। আরও একটি দায় নিজের কাঁধে আছে। একাত্তর সালের ১৬ নবেম্বর শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস। হাওড় অঞ্চলের এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় স্তরের মানুষেরা জানেন বলে মনে হয় না। ১৬ নবেম্বর তো দূরের কথা অন্য কোন দিনও তার নাম কাউকে উচ্চারণ করতে শুনি না। জগৎজ্যোতি যে লড়াইতে শহীদ হন হাওড়ে তার মতো বড় যুদ্ধও আর হয়নি। তিনি যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন তাতে আমরা তাকে কেন যে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিইনি তাও আমি জানি না। ইতিহাস আমাদের সে জন্য ক্ষমা করবে না। উল্লিখিত সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েই আমি কিছু কথা লিখতে পারি। সময় পেলেই ওদের নিয়ে আমি লিখবও। আপাতত জগৎজ্যোতির ইতিহাসটা পড়ুন। মাহবুব ভাই, আফতাব আর কাইযূমের সঙ্গে আমার যতটা গাঢ় সম্পর্ক ছিল, জগৎজ্যোতির সঙ্গে তেমনটা ছিল না। তিনি আমার চাইতে এক শ্রেণী ওপরে একই স্কুলে পড়তেন। আমার চাচাত ভাই আব্দুল হান্নান ও দুই ভাগিনা-আবিদ ও হেলিম তার সহপাঠী ছিল। আবিদ আজ আর নেই। তবে সে জগৎজ্যোতির গ্রামের বাড়ি জলসুখাতেই লজিং থাকত। ওরা একসঙ্গে স্কুলে আসত। শুকনো মৌসুমে একসঙ্গে হেঁটে আসতেন তারা। বর্ষায় আসতেন এক নৌকায়। দারুণ বন্ধুত্ব ছিল ওদের। ওরা ’৬০ সাল থেকে ’৬৫ সাল অবধি পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়েছেন। আমরা তাদের ’৬১ থেকে ’৬৫ এই চার বছর দেখেছি। আমরা স্কুল ছাড়ার আগের বছর তারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ছাড়েন। তবে এরপর আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। অন্যদিকে আমার সঙ্গে জগৎজ্যোতির সম্পর্কটা স্কুলেই সীমিত থাকেনি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধের জন্য। তিনি একাত্তর সালে যে যুদ্ধে শহীদ হন আমি সেই এলাকারই বাসিন্দা। আরও একটি বড় বিষয় হচ্ছে; আমি বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে জগৎজ্যোতির খুনি ও পলাতক রাজাকারদের আমার গ্রামের বাড়িতে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলাম যাদের শাল্লার মুক্তিযোদ্ধারা পরে হত্যা করে। আমি সেই ইতিহাসটি লিখব। জগৎজ্যোতি আমার গ্রামে বা তার পাশের গ্রাম কল্যাণপুরে সাধারণ মানুষের ভরসার কেন্দ্র হিসেবে আসা যাওয়া করতেন। আমাদের গ্রামের বাজার কৃষ্ণপুর ছিল তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পের মতো। যদিও আমি তখন ভারতে তথাপি আমি পরে জেনেছি যে, শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামটিকে তাদের নানা কাজে ব্যবহার করত। আমাদের বাজারটি তাদের রসদ যোগাত। আমার চাচাত ভাই ডাঃ নিয়াজ মুহম্মদ তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আর বাবা আবদুুল জব্বার তালুকদার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। হাসান মুর্শেদ নামক একজন জগৎজ্যোতির ওপর একটি বই লিখেছেন- যার অংশ বিশেষ একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হাসান মুর্শেদের কাছ থেকে জগৎজ্যোতির যুদ্ধের ইতিহাসটি নিচ্ছি। আসুন একটু যুদ্ধের শুরুর বিবরণটি পাঠ করি। ‘সেদিন জগৎজ্যোতির দলটা ছিল ৪২ জনের। খালিয়াজুড়ির কল্যাণপুর থেকে কয়েকটা নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটার মূল অপারেশন ছিল আজমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন উড়িয়ে দেয়া। যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা সুবল দাসের দলকে সাহায্য করার জন্য ঘুঙ্গিয়ার গাঁও, শাল্লায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে গুলিবিনিময় করেছে জ্যোতির দল। সেখান থেকে ভোরে রওনা হয়ে সকাল নয়টায় ইউনিয়ন অফিসের সামনে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের নৌকা, তেলাপোকাগুলো নিরীহ জেলেদের নৌকা আটকে লুটপাট করছে। এক জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে আকুল স্বরে অনুনয় করল ও দাসবাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান।’ তৎক্ষণাৎ আক্রমণে কয়েক রাজাকার মারা যায় সেখানেই। বাকিরা দুই নৌকায় ইঁদুরের বাচ্চার মতো পালিয়ে আসতে থাকে। জ্যোতি বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে বারোজনকে সঙ্গে নিয়ে তাড়া করেন সেই পলায়নপর তেলাপোকাগুলোকে। অন্যরা তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, জগৎজ্যোতি ধমক দিয়ে বলেছে, কয়টা রাজাকার ধরতে সবার আসার কি দরকার? নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে শুকনো বিল পেরিয়ে তেলাপোকাগুলো পালিয়ে যায় জলসুখার দিকে। জলসুখা জ্যোতির গ্রাম। নাড়িপোতা ঠিকানা। কিন্তু জ্যোতি তখন অপারেশনে, তাই কাছে এসেও ফিরে যান। যাওয়ার সময় মর্টারের রেঞ্জের কাছাকাছি এক রাজাকারের বাড়িতে মর্টার শেলিং করে ওরা। ফেরার সময় হঠাৎই পাল্টে যায় সবকিছু। হঠাৎ চায়নিজ রাইফেলের গুলির আওয়াজ ভেসে আসে অনতিদূর থেকে। চায়নিজ রাইফেল পাকিস্তানীদের অস্ত্র, রাজাকারদের কাছে চায়নিজ রাইফেল থাকার কথা নয়। ওদের দৌড় বন্দুক পর্যন্তই। বিলের কাছে আসার পর ওরা দেখে, একদিকে আজমিরীগঞ্জ, অন্যদিকে শাল্লা ও মার্কুলির দিক থেকে গানবোটে করে পাকিস্তানী আর্মিরা এসে নদীর পাড়ে পজিশন নিচ্ছে। ঠিক উল্টো দিকের বদলপুরেও গুলির আওয়াজ। রাজাকারগুলো ছিল আসলে ঘুঁটি, ওদের টোপ হিসেবে কাজে লাগিয়ে শেষপর্যন্ত সুনামগঞ্জের হাওড় অঞ্চলে পাকিস্তানীদের ত্রাস দাস পার্টিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তান আর্মি। সুপ্রশিক্ষিত হিংস্র পাকি হায়েনাগুলো এতদিন রোম ওঠা নেড়িকুকুরের মতো সকাল-বিকেল মার খেয়েছে দাস পার্টির দুর্ধর্ষ গেরিলাদের হাতে, আজ তারা আটঘাট বেঁধেই এসেছে। দুই দিক থেকেই পাকিস্তান আর্মি পজিশন নেয় নদীর পাড় জুড়ে, আর জ্যোতির দলের ১২ জন পজিশন নেয় নদী আর শুকনো বিলের মাঝে। দূরত্বটা এতই কাছে যে, পাকি জওয়ানদের পজিশন নেয়ার জন্য অফিসারদের দেয়া উর্দু কমান্ডও শুনতে পাচ্ছিলেন জগৎজ্যোতিরা। জ্যোতি আর তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ইলিয়াস সামনের কলামে, দু’জনের হাতেই মেশিনগান আর দুই ইঞ্চি মর্টার- এরপরের সারিতে মতিউর, রশিদ, আইয়ুব আলী, বিনোদ বিহারী বৈষ্ণব, ধন মিয়া, কাজল, সুনীল, নীলু, কাইয়ুম ও আতাউর। বিপরীতে অগুনতি পাকিস্তানী সেনা। যুদ্ধ শুরু হলো সামনা-সামনি। (চলবে) ঢাকা ॥ ১৬ ডিসেম্বর, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×