ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অতিরিক্ত ভোগ বনাম সঞ্চয়

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ১০ নভেম্বর ২০১৭

অতিরিক্ত ভোগ বনাম সঞ্চয়

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একবার অর্থনীতির মন্দা কীভাবে কাটানো যায় তার ওপর সুপারিশ কামনা করে জগদীশ ভগবতীর শরণাপন্ন হন। মনমোহন সিং নিজে একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ যিনি ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনেরও প্রধান ছিলেন, ছিলেন দীর্ঘদিন অর্থমন্ত্রী। এদিকে জগদীশ ভগবতী আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েও পাচ্ছেন না। তাকে ‘অবাধ বাণিজ্যের পিতা’ও (ফাদার অব ফ্রি ট্রেড) বলা হয়। কারণ তারই ‘কর্মফল’ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এই সংস্থাটিই বিশ্বায়নের মূল চালিকাশক্তি। বিশ্বময় অবাধ বাণিজ্যের উদ্যোক্তা। এ হেন দুইজন অর্থনীতিবিদ ভারতীয় অর্থনীতির মন্দা কাটানোর জন্য বছর দশেক আগে ‘পথের সন্ধানে’ ছিলেন। জগদীশ ভগবতী মজার এক সমাধান সুপারিশ করেন বলে এক খবরে দেখলাম। তিনি বললেন, ‘ভোগ’ (কনজামশন) বাড়ানো দরকার ‘সঞ্চয়’ (সেভিংস) কমানো দরকার। ভারতের নারীকুল বড় বেশি সঞ্চয়শীল। এ কারণে ভারতের সঞ্চয় বেশ বেশি। অত্যধিক সঞ্চয় প্রবণতার কারণে ‘ভোগ’ স্তর নিচে। এটা ওপরে তোলা দরকার। মানুষকে আরও বাজারমুখী করা দরকার। মানুষ বেশি বেশি বাজারে গেলেই জিনিসের চাহিদা বাড়বে। চাহিদা বাড়লে শিল্পপতিরা উৎপাদন বাড়াবে, নতুন নতুন বিনিয়োগ হবে। তাহলেই লোকের কর্মসংস্থান হবে। ‘জবলেস গ্রোথের’ বদনাম কাটবে। এই হচ্ছে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর ‘ফর্মুলা’। এই ‘ফর্মুলা’কে একটু সম্প্রসারিত করলে আমরা পেয়ে যাব ভারতের এক দার্শনিককে যার নাম ‘চার্বাক’। তিনি কৌটিল্য বলেও পরিচিত। আড়াই হাজার বছর পূর্বে চার্বাক বলতেন, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ।’ ঋণ করে ঘি খাও। যতদিন বাঁচ সুখে বাঁচ। দারুণ উপদেশ যা তৎকালীন ভারতের লোকেরা মান্য করেনি। এমনকি চরম ভোগবাদের এই দিনেও ভারতের লোকেরা এখনও এই আদর্শে অনুপ্রাণিত নয়। এ কারণেই যথারীতি জগদীশ ভগবতীর উপদেশ ভারত সরকার শোনেনি বলে খবরে বলা হয়েছে। ওরা শোনেনি বলে কী হবে, পৃথিবীর দেশে দেশে ক্ষমতা কমানো এবং ভোগ বাড়ানোর নানা উদ্যোগ-আয়োজন বছরব্যাপীই চলছে। এর আদর্শ দেখা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দেশে ভোগই আদর্শ। সঞ্চয়ের কোন প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রই সেখানে সব দেখভাল করে। চাকরি গেলে রাষ্ট্র দেখাশোনা করে। বৃদ্ধদের রাষ্ট্র দেখাশোনা করে। অসুস্থ হলে রাষ্ট্র চিকিৎসার ভার নেয়। বিপদে-আপদে রাষ্ট্রই ভরসা। অতীত-ঐতিহ্য বলতে তাদের কিছু নেই। দুনিয়ার বারো জাতের মানুষ মিলে গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। ‘পরিবার’ বলে যে সামাজিক কাঠামো তা সেখানে ভেঙ্গে চুরমার। ছেলে-মেয়েরা বিয়েশাদি করতে চায় না। পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে রাষ্ট্র। এহেন আদর্শের আদলে অনেকেই আমাদের দেশসহ অনেক দেশকেই গড়ে তুলতে চায়। যে কারণে বাংলাদেশেও বহু অর্থনীতিবিদ সঞ্চয়কে বড় মনে করেন না। তারাও ‘ভোগ’ ‘ভোগ’ করেন। মজার বিষয় তারা শ্রমিকের ন্যায্য বেতন-মজুরির কথা বেশি বলেন না। চাকরি গেলে তাদের স্বার্থের কথা ওইসব অর্থনীতিবিদ বলেন না। তাদের কাছে ভোগই সবকিছু। কিন্তু আমাদের দেশ যে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা নয় তা তারা বুঝতে চায় না। আমাদের সমাজ ‘পরিবার কেন্দ্রিক’ যার কেন্দ্রে পিতা-মাতা। গরিব-দুঃখী প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বেকার ভাইবোন, বিধবা পিসি-মাসিÑ সবাইকে নিয়েই বাঙালীর চলতে হয়। চিকিৎসার খরচ রাষ্ট্র দেয় না। হাসপাতালে ঢুকলেই যে ১০-২০ হাজার টাকা খরচ হয় তা মধ্যবিত্ত বাঙালীকেই বহন করতে হয়। চাকরি পাওয়া দুষ্কর। চাকরিচ্যুতি ঘটলে রাষ্ট্র দুই-পয়সা দিয়েও সাহায্য করে না। কেউ ‘গ্রুরেল কিচেন’ বা লঙ্গরখানাও করে রাখেনি যেখানে গিয়ে মুখে খিচুড়ি দেয়া যাবে। বাবা-মাকে পালতে হয়। তাদের চিকিৎসা করাতে হয়। বেকার ভাইবোন পালতে হয়। তাদের বিয়েশাদির খরচ জোগাড় করতে হয়। এমনকি বিধবা আত্মীয়-স্বজনকেও আশ্রয় দিতে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী বিপদে পড়লে অর্থ সাহায্য দিতে হয়। এসব কর্মকা-ে রাষ্ট্র কোথায়, কোথায় সরকার? এগুলো বাঙালীর সামাজিক দায়বদ্ধতা। উপরন্তু তাকে দিতে হয় ধর্মীয়ভাবে ‘যাকাত’। কী মনে হয়, এসব দায়িত্ব পালনে কেমন টাকা লাগে? এই টাকা কোত্থেকে আসবে? যদি সঞ্চয় না থাকে তাহলে বিপদ-আপদ সামলানোর জন্য, সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজ নির্বাহ করার জন্য টাকা কোত্থেকে আসবে? এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। অথচ ‘ভোগ’ উৎসাহিত করার জন্য সমস্ত আয়োজন চারদিকে। কীভাবে? প্রথমত সঞ্চয় নিরুৎসাহিত করে। আমানতের ওপর সুদ নেই। এতদিন বলা হয়েছে মূল্যস্ফীতির হার খুবই কম। যুক্তি তখন ব্যাংকারদের। এখন মূল্যস্ফীতির হার আবার বাড়ছে। সাত শতাংশ হয় হয়। শাক-সবজির দাম প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়েছে বিগত মাসের মধ্যে। মাছ-মাংসের দামও তাই। পেঁয়াজের দামের কথা নাই বা বললাম। কই, এখন তো কেউ কথা বলেন না। এখন তো কেউ বলেন না যে, ব্যাংকের সুদ বাড়ানো দরকার। হৈচৈ সঞ্চয়পত্র নিয়ে। প্রায় তুলেই দেয়া হয়। সৌভাগ্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সঞ্চয়পত্র বেঁচে যাচ্ছে। তার সুদও ঠিক আছে। বেচাকেনাও হচ্ছে। এর থেকে মানুষের দৈনন্দিন খরচের একটা অংশ আসছে। এসব ‘মাধ্যমে’ যদি সঞ্চয় না হতো তাহলে কী উপায় হতো? এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। কিছুদিন আগে ব্যাংক সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল সরকারের একজন নীতি নির্ধারকের সঙ্গে। টাকা জমা দেয়া, টাকা তোলা, পে-অর্ডার করা ইত্যাদি ‘সেবা’ নিতে গিয়ে গ্রহকরা কী হয়রানির সম্মুখীন হন সেসবই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। এখন হিসাব-খুলতে গেলে গ্রাহক আমেরিকার নাগরিক কীনা, সেখানকার গ্রিনকার্ড হোল্ডার কীনা, আমেরিকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের আয় আছে কীনা এসব তথ্যও দিতে হয়। অথচ এসবের সঙ্গে গ্রামের একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীর কোন সম্পর্ক নেই। টেলিফোন নম্বর দিতে গেলেও ব্যাংকের কাছে মোবাইল নম্বর দিতে হয়। পিতার হিসাবে পুত্র টাকা জমা দিলেও ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দিতে হয়। এই যে কর্মকা- এর অর্থ কীÑএ কথাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলছিলেন তখন মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইনের কথা। বোঝাচ্ছিলেন আমাকে ভোগের কথা, সঞ্চয়ের কথা। তিনি হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘টাকা’ একটা বিপজ্জনক জিনিস। এটা থাকবে ব্যবসায়ীদের, শিল্পপতিদের ওরাই বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা। বলছিলেন, মানুষের সঞ্চয় করার দরকার নেই। টাকা থাকলেই ব্যাংকে যেতে হয়। রোজগার কর, খাও-দাও ফুর্তি কর। জমাতে গেলেই বিপদ। ভাল টাকা খারাপ টাকা যাই হোক না কেন তা থাকলেই বিপদ। অতএব একমাত্র ‘মেডিসিন’ টাকা ওড়াও, ভোগ কর। দুনিয়াটা স্বল্পদিনের। ওই নীতি নির্ধারক হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলেন বটে, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে সারা পৃথিবী এখন নেমেছে ‘ভোগ’ (কনজামশন) বাড়াবার জন্য। সঞ্চয়ের দরকার নেই। ঠিক আছে ভোগ বাড়ালাম, কিন্তু আমার বিপদের দিনে আমাকে কে দেখবে? শ্বশুরবাড়ির লোকেরা? মুশকিল হচ্ছে তাদেরও তো টাকা নেই। সবচেয়ে বড় কথা ‘ব্যাংক-ড্রিভেন’ উন্নয়নে মানুষের সঞ্চয় না থাকলে উন্নয়নের টাকা আসবে কোত্থেকে? ব্যাংক তো মানুষের সঞ্চয়ই ‘আমানত’ হিসেবে রাখে। উন্নয়ন কী তাহলে ‘শেয়ারবাজারের’ টাকা দিয়ে হবে? তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বাংলাদেশে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুলে শিল্প করার কথা যারা চিন্তা করে তারা ভিন্ন জগতের মানুষ। যারা শিল্প করবেন তারা এমন কথা জীবনেও ভাবেন না। তাহলে কী রাষ্ট্র উন্নয়নের টাকা জোগাবে? রাষ্ট্রের টাকা কোথায়? রাষ্ট্র তো ‘ঘাটতি বাজেটে’ চলে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। প্রতিবছর তাই। তাহলে উপায় বিদেশী ‘সাহায্য’। ‘সাহায্য’ নেই। চীনারা ঋণ দেয়, ‘সাহায্য’ দেয় না। এমনকি বিনিয়োগও করে না। বাংলাদেশের বিনিয়োগে তাদের অবদান যৎসামান্য। সঞ্চয় কমিয়ে ভোগ বাড়িয়ে তাহলে শেষ পরিণতি কী হবে? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×