বছর শেষের নানা আয়োজন এবং বর্ষবরণের প্রস্তুতি- এসব নিয়ে ঢাকাবাসীর ব্যস্ততা গেল ক’দিন। মাসের এক তারিখ মানেই নতুন হিসাব। ভাড়া বাসায় যারা থাকেন তাদের বাসাবদলের কাজটি করতে হয় মাসের এক তারিখে, কিংবা তার আগের দিন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় নতুন বছরের শুরুতে বেশিসংখ্যক ভাড়াটিয়া বাসা বদল করেন। নতুন বছরে নতুন বাসায় যাওয়ার বিলাসিতা এটি নয়। এর পেছনে নানা সমস্যা ও প্রয়োজনের ব্যাপার থাকে। আইন অনুযায়ী প্রতি দু’বছর অন্তর বাড়িঅলারা বাসার ভাড়া বাড়াতে পারেন। অথচ এটা এখন নিয়মেই পরিণত হয়েছে যে ঢাকার বিপুল সংখ্যক বাড়িঅলা ফি বছরই বাসা ভাড়া বাড়ান। আর এই বাড়ানোর সময়টা হলো নতুন বছরের প্রথম দিন। তাই বাড়তি ভাড়া গোনার ক্ষমতা যাদের নেই তারা আগের বাজেটের মধ্যে নতুন বাসায় উঠে যান, মানে যেতে বাধ্য হন। তাই বছরের প্রথম দিন কিংবা তার আগের দিন ঢাকার রাজপথে অলিতে গলিতে ট্রাকে ও ভ্যানে, এমনকি ঠেলা গাড়িতেও সংসারের মালসামান চাপিয়ে বাসা বদল করতে দেখা যায়। বাসা বদল বিরাট ঝক্কির ব্যাপার। এখন এই ঝক্কি কমাতে পেশাদার প্রতিষ্ঠানও দাঁড়িয়ে গেছে। বাসা বদলের ঝামেলা ও কষ্ট সব তারাই বহন করে। এতে টাকা খরচ হলেও অনেকে এই প্রক্রিয়াতেই বাসা বদল করেন।
শীতে সাধারণত ঢাকায় বেশ কয়েকটি এলাকার বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কম থাকে। বিগত বছরগুলোতে যে সব এলাকায় (বিশেষ করে পুরনো ঢাকায়) এ সমস্যা ছিল এবারও সেসব স্থানে একই সমস্যা বিরাজ করছে। বরং সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। উত্তরায় আছি একযুগ, এ বছরই প্রথম গ্যসের সঙ্কট দেখলাম। দিনের বেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্নার কাজে বিঘœ ঘটছে। আবার অনেক সময় পুরোপুরি বন্ধও থাকছে গ্যাস। এটা ঠিক যে কারিগরি ত্রুটি, পাইপ লাইনে ময়লা জমে থাকা, রক্ষণাবেক্ষণের কাজসহ নানা কারণে ঢাকায় কোন কোন এলাকায় গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতেই পারে। কিন্তু নিয়মিতভাবে এ অবস্থা চললে সেটি দুর্ভোগের পর্যায়ে চলে যায়। গ্যাসের মজুদ কমে আসছে- এটা সত্য। আবার গ্যাসের চাহিদাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। বিদ্যুত সরঞ্জাম ব্যবহার করেও আংশিকভাবে রান্না করছেন বহু ঢাকাবাসী। সেক্ষেত্রে আবার বিদ্যুতের খরচ ও চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে, আবার সমাধানের পথও বের হয়ে আসছে। ঢাকাবাসী হয়ে উঠছে সর্বংসহা নাগরিক।
পানির নাম মরণ নয়
পানির নাম জীবন- শিশুরা বিদ্যালয়ে গিয়েই এই শিক্ষা পায়। পানি যে মরণের আরেক নাম হয়ে উঠতে পারে সেটা বুঝে উঠতে হলে খানিকটা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া লাগে। বলতে পারি, পানির আর কী দোষ! তাতে দোষণীয় বস্তু/ জীব দ্রবীভূত বা অদৃশ্য অবস্থায় থেকে পানিকে দূষিত করে তোলে। পানির দোষে বিদেশ থেকে বেড়াতে আসা এক বন্ধু তিন দিন শয্যাশায়ী থাকলেন। লঞ্চে করে গিয়েছিলেন দেশের বাড়ি। ফেরার সময় লঞ্চের চা খেলেন। ভাবলেন গরম পানি, তাই নিশ্চয়ই জীবাণুমুক্ত। দেশে থাকলে জানতেন লঞ্চের চা মানে নদীর পানি দিয়ে চা। সেই পানি যদি যথোপযুক্তভাবে ফোটানো যায় তাহলে হয়ত ঝুঁকি থাকে না। সে যাক, পানি নিয়ে এত কথা হচ্ছে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণে।
ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির জারে কাঁচা পানি বিক্রির দায়ে দুই প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে সম্প্রতি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত বোতলজাত পানি ‘শান্তি’র ২০ লিটারের জারে বিশুদ্ধ (মিনারেল) পানির পরিবর্তে কাঁচা পানি ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। এমনকি শান্তির ছোট বোতলগুলোতেও নকল পানি ভরে দেওয়া হচ্ছে। এমন সংবাদ আমাদের বিস্মিত ও রুষ্ট করে তোলে। ঢাকায় বোতলজাত পানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে ওয়াসার বাজার ধরা এমন কিছু কঠিন নয়। এখন নেতিবাচক সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ওয়াসার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তার মানে সরকারী প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সুযোগে অসরকারী বা প্রাইভেট কোম্পানির সুবিধা বাড়বে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়াসার বোতলজাত পানির কারখানা নির্মিত হয়। ২০০৬ সালের ৩০ জুলাই উদ্বোধনের পর সেপ্টেম্বরে এটি বাজারে আসে। কিন্তু চাহিদা থাকলেও ভোক্তারা ‘শান্তি’র নাগাল পান না। এখনও এটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পানির মতো সহজলভ্য নয়। এর মধ্যেও যাদের এই শান্তি পানির ওপর নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, তারা এখন প্রতারণার শিকার হচ্ছে। ডিলারদের সরবরাহ করা কাঁচা পানি খেয়ে অনেক ভোক্তা পেটের পীড়াসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। দীর্ঘদিনের এই ব্যর্থতার জন্য ওয়াসা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাব এবং ওয়াসারই কিছু লোকের দুর্নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে।
থার্টিফার্স্টের আনন্দ
ঢাকার রাতও যে বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করে সেটি আমাদের আলোচনায় তেমন আসে না। সচরাচর আসে দিবসের কর্মকা- ও ঘটনা। ব্যতিক্রম শুধু কয়েকটি রাত। যেমন ইংরেজী (গ্রেগরীয়) নতুন বছর শুরু হওয়ার রাতটি। রাত বারোটা এক মিনিটে গণনা করা হয় নতুন বছরে পদার্পণের ক্ষণ। অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। এবার থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের ব্যাপারে আগাম কিছু নির্দেশনা মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। ফলে ধারণা করা গিয়েছিল ঢাকার রাস্তায় অন্তত এবার খুব একটা হৈ-হুল্লোড় হবে না। আনন্দ-ফুর্তি যা হওয়ার তা ঘরোয়াভাবেই হবে। রাজধানীর বারগুলোয় রমরমা ভাব থাকে উইকএন্ডে, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারে। এবার বছরের শেষ দিন থার্টিফার্স্ট পড়েছিল শনিবারে। অথচ ঢাকার সব বার বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে। তাই সেদিন সকাল থেকেই বোঝা যায় মধ্যরাতে এবারকার ইংরেজী বর্ষবরণে ঢাকা মোটামুটি একটা অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতা অর্জন করবে গত বছরের মতোই। হয়েছেও তাই। বিগত দুই দশকের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করছে থার্টিফার্স্ট নাইট। মজার ব্যাপার হলো কয়েকটি টিভি চ্যানেল সন্ধ্যার পর রাজধানীর রাজপথের ছবি দর্শকদের দেখানোর জন্য লাইভ সম্প্রচারে যায়। পানীয় ছাড়াও উৎসব হতে পারে, আর ঘরোয়াভাবেও সেটা সম্ভব। এমন একটি সমান্তরাল রীতি যদি রাজধানীতে চালু হয় সেটাও মন্দ কী! যারা থার্টিফার্স্টে থার্স্টি থাকেন, তারা তৃষ্ণা নিবারণ করুন রেখঢেকে। বাকিরা অন্য উৎসব জমাক। তবে না বললেই নয়, ঢাকায় বসবাসকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশীর বেলায় বিষয়টি শিথিলযোগ্য হতে পারে কিনা সেটা ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
ফলোআপ : ফার্মগেট পার্ক
আমরা এই কলামে ঢাকার দুই মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার সমাধান ও অনিয়মের সুরাহা চাইতে শুরু করি বিদায়ী বছরের প্রথম সপ্তাহ থেকে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। ঠিক এক বছর আগে আমরা ফার্মগেটের পার্কের দৈন্যদশা তুলে ধরেছিলাম। নগরবাসীর খানিকটা আনন্দের জন্য, অবকাশযাপনের জন্য উদ্যান বা পার্কের তুলনা নেই। খোলা পরিবেশে অক্সিজেনসমৃদ্ধ খোলা বাতাসের ভেতর ঘুরে বেড়ানো, হাসি আর গানে মেতে ওঠার জায়গাগুলো ক্রমশ সঙ্কুচিত ও বেহাল হয়ে উঠেছে। ফার্মগেট ঢাকার অন্যতম একটি প্রাণকেন্দ্র। সেখানে একটি পার্ক রয়েছে। কিন্তু এর ভেতরে কিছুক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। রীতিমতো ভাগাড়খানা হয়ে উঠেছে এই পার্ক। কোন রকম যতেœর ছাপ নেই। আমরা মেয়রের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম রাজধানীর অন্তত এই একটি পার্ককে রাহুমুক্ত করা হোক নতুন বছরের শুরুতেই। গত এক বছরে এদিকে নজর দিতে পারেননি মেয়র। সম্প্রতি আজব কথা শোনা গেল। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) স্থানীয় কাউন্সিলর বলছেন যে এ ব্যাপারে তার আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। পার্কটির উন্নয়নের বিষয়টি তার নির্বাচনী ওয়াদাও বটে। কিন্তু পার্কটি গণপূর্ত অধিদফতরের অধীনে হওয়ায় তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যে এ ধরনের সমস্যা বা জটিলতা কোন নতুন বিষয় নয়। জোরালো সদিচ্ছা থাকলে এর চেয়ে জটিল সমস্যারও যে সমাধান সম্ভব ডিএনসিসির মেয়র ইতোপূর্বে নিজেই তার একাধিক দৃষ্টান্ত রেখেছেন। সুতরাং অজুহাত থেকে কুড়ি হাত তফাতে যান, দয়া করে।
বছরের প্রথম দিনই জন্মদিন!
সহযোগী এক সংবাদপত্রের এক আলোকচিত্রীর স্ত্রীর সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল সাতই জানুয়ারি। ডাক্তার জানালেন ১ তারিখেই হয়ে যাবে। হলোও তাই। বছরের প্রথম দিন শিশুটির জন্মদিন হলো। এটি জেনুইন জন্মদিন। কিন্তু দেশে বহুলোকের ‘তৈরি করা’ জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি। এখন ফেসবুকের কল্যাণে সংযুক্ত বন্ধুদের জন্মদিন নিয়ে আগাম নোটিফিকেশন আসে। ফেসবুকে বন্ধু সংখ্যার সীমা ৫ হাজার পর্যন্ত। আমার দু’হাজারের মতো বন্ধু, তার ভেতরে অর্ধশতাধিক বন্ধুর জন্মদিন ১ জানুয়ারি, মানে বছরের প্রথম দিন। এ নিয়ে নানা পোস্টে মুখর হয়ে ওঠে ফেসবুক বছরের প্রথম দিনেই। একজন স্ট্যাটাস দিয়ে জানালেন তার আড়াইশোর মতো বন্ধুর জন্মদিন ১ জানুয়ারি। একজন সচেতন ব্যক্তি এ নিয়ে যে পোস্ট দিয়েছেন সেটি উল্লেখ করার মতোই। তিনি লিখেছেন : ‘আজকে যাঁদের জন্মদিন তাঁরা যে মহাবিপদে আছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে ফেসবুকের নানা ধরনের পোস্ট দেখে। অধিকাংশ পোস্টই উপহাসমূলক, যেন এই দিনে জন্মদিন হওয়া তাঁদের জন্য অপরাধ। এ-কথা ঠিক যে, এই জন্মদিনগুলোর বেশিরভাগই স্কুলের তৈরি। একটা সময় ছিল যখন মা-বাবারা সন্তানদের জন্মদিনের ব্যাপারে আদৌ সচেতন ছিলেন না, মনেও রাখতেন না তারিখটি, লিখে রাখা তো দূরের কথা। জন্ম-সনদের কোন প্রয়োজন পড়ত না, একটা তারিখ স্কুলের খাতায় লিখতে হয় তাই শিক্ষকরা বা দপ্তরিরা এমন একটা তারিখ লিখতেন যেন হিসাব করতে সুবিধা হয়। শুধু তাই নয় মুসলমান ছাত্রদের নামের আগে মোঃ লাগিয়ে দেয়ারও একটা ব্যাপার ছিল। মা-বাবা জানতেও পারতেন না, জানতে চাইতেনও না যে তাঁদের সন্তানের নাম বা জন্মতারিখ কী লেখা হয়েছে! একাধিক সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের ভরণ-পোষণের চিন্তায় এমনিতেই তাঁরা কাহিল থাকতেন, এসব ‘তুচ্ছ’ বিষয় নিয়ে চিন্তার সময় তাঁদের ছিল না। অনেকেই এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র বা সার্টিফিকেট পেয়ে তাঁদের ফর্মাল নাম ও জন্মতারিখ জানতে পারতেন। এই ঘটনা ঘটেছে যুগের পর যুগ ধরে। অনগ্রসর, অশিক্ষিত, দরিদ্র সমাজে এমনটি ঘটারই কথা। এ দেশে এফিডেভিট করে নাম-জন্মতারিখ পরিবর্তন করাও এক বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। ফলে স্কুলের শিক্ষক বা দফতরির দেয়া সেই ভুল নাম, ভুল জন্মদিন বয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেক মানুষকে সারা জীবন ধরে। কিন্তু এটা তো তাঁদের কোন অপরাধ নয়! ইচ্ছে করে তো তাঁরা এটা করেননি! এ নিয়ে নিশ্চয়ই তাঁদের মনে লজ্জাবোধ আছে, দুঃখবোধ আছে। তারপরও উপহাস করে, টিটকারি দিয়ে যারা তাঁদের সেই লজ্জাকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন, তারা, আর যাই হোন, সংবেদনশীল মানুষ নন।’
১ জানুয়ারি ২০১৭
[email protected]
শীর্ষ সংবাদ: