ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাইব্যুনাল সরানো যাবে না

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৩০ আগস্ট ২০১৬

ট্রাইব্যুনাল সরানো যাবে না

১৮ আগস্ট সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন কর্তৃক প্রদেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নোটিসটি দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। এ নিয়ে সর্বস্তরের জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই নোটিস প্রত্যাহারের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ৮টি সংগঠন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনও করেছে শনিবার। সেখানে তারা বলেছে, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে ঘোষণা করা হবে নতুন কর্মসূচী। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য শুরু থেকেই এই ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এবং বিচার কার্য পরিচালনা নিয়ে বিতর্কসহ নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়, যার রেশ এখনও চলমান। তবে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিসহ গণজাগরণ মঞ্চ সর্বোপরি সর্বস্তরের গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই এগিয়ে চলেছে যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধীদের বিচার। ইতোমধ্যে কিছু রায় বাস্তবায়িত, কিছু মামলা বিচারাধীন এবং মাঠপর্যায়ে তদন্তসাপেক্ষে নতুন নতুন মামলাও দায়ের করা হচ্ছে একাত্তরের ঘাতক দালার রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। বলা যায়, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কেননা, এই বিচার হচ্ছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, ৩ লাখ নির্যাতিত নারী, অগণিত আহত, সপরিবারে নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা, সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দেশ ও মানুষের সকৃতজ্ঞ দায়বদ্ধতা থেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার অন্যতম স্মৃতিচিহ্ন ঐতিহাসিক এই ভবনটি স্বভাবতই বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিসত্তার অহঙ্কারের প্রতীক, বিজয়ের প্রতীক। যদি কেউ যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তবে সেই বিচারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক। সর্বোপরি সারাবিশ্বে যে বা যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায়, তাদেরও প্রতীক। সেসব দিক থেকে অবশ্যই এই ভবনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব রয়েছে। দুঃখজনক ও পরিতাপের বিষয় হলো, সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন দেশ ও জাতির এই অন্যতম অনুভূতি, শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্থানটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে বর্তমানে পর্যাপ্ত স্থানাভাবের বিষয়টিও সুবিদিত। যে কারণে বিচারপতিদের প্রয়োজনীয় চেম্বার, এজলাসসহ রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। তবে সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে অনেক স্থান আছে, যেখানে প্রয়োজনে নতুন ভবন স্থাপন ও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। সুপ্রীমকোর্টের পাশেই সড়ক ভবনের যে জায়গাটি পেয়েছে, সেটি সুপরিসর ও আকর্ষণীয়। সেই স্থানটি নেয়া হয়েছিল বিচারকদের এজলাস করার জন্যই। সেখানে বর্তমানে সেলুন, জিমনেসিয়াম, বিউটি পার্লার ইত্যাদি রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব অপসারণ করেও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে সর্বোচ্চ আদালতের পরিসীমা। মনে রাখতে হবে, সুপ্রীমকোর্ট যেমন একটি আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও তেমনি একটি বিশেষ আদালত। এর সঙ্গে সমগ্র দেশ ও জাতি সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষা-গর্ব ও অহঙ্কার জড়িত ওতপ্রোতভাবে। সুতরাং- আদালতে আদালতে মুখোমুখি অবস্থান নয়, বরং পারস্পরিক সহাবস্থানই প্রত্যাশিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির নুরেমবার্গের যে ভবনে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল, সেটি পরে রূপান্তরিত হয়েছে জাদুঘরে, উত্তর প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে। অনুরূপ হয়েছে জাপানে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাজ এখনও শেষ হয়নি। মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা ও সচলতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। দায়িত্ব শেষ ও সম্পন্ন হওয়ার পরই না হয় ভবনটিকে স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরের কথা ভাবা যাবে। জমি কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অধিভুক্ত থাকলেও বাস্তবে তা সরকার বা রাষ্ট্রের। সে অবস্থায় সরকার তথা আইন মন্ত্রণালয়, সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই একত্রে বসে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেবে বলেই প্রত্যাশিত।
×