ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

কিছুতেই কাটে না আলো-আঁধারি

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১ জুন ২০১৬

কিছুতেই কাটে না আলো-আঁধারি

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আরেক দফা ‘সফল গবেষণা’র পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে এখন থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি বাড়ল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। তবে সহস্রাব্দের প্রথম দশক শেষে প্রয়োগ করা আরেক ‘গবেষণালব্ধ’ পদ্ধতি পিএসসি বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বহাল থাকবে কিনা তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। নানা কারণে এ সিদ্ধান্ত হওয়া জরুরী। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার সুপারিশ করেছিল কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন সেই উনিশ শ চুয়াত্তর সালে। মাঝে পেরিয়েছে বিয়াল্লিশ বছর। স্বাভাবিকভাবেই বাস্তবতাও বদলছে অনেক। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন যখন সুপারিশ করেছিল তখনও শিক্ষার এতটা বাণিজ্যিকীকরণ হয়নি। জীবনের শুরুতেই শিশুদের পরীক্ষার ফাঁসিকাঠ পেরোতে হয়নি এবং শিক্ষা বাণিজ্যের গিনিপিগ হয়ে কোচিং সেন্টারে দৌঁড়াতে হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য আজও এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা স্থিতিস্থাপকতা অর্জন করতে পারল না। সেই শুরু থেকেই একের পর এক নানা ধরনের ‘গবেষণা’ চলছে গুরুত্বপূর্ণ এখাত নিয়ে। শোনা যায়, এক বার নাকি পাশ্চাত্যের এক পশু মনস্তত্ত্ববিদ এসেছিলেন এ দেশের মানব শিশুদের ওপর শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা করতে। এখন অবশ্য দেশেই প্রচুর ‘বিশেষজ্ঞ’ আছেন। যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে নতুন নতুন নিরীক্ষা করছেন। নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন। এক পদ্ধতি ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করলেন- কয়েক বছর চলল। তারপর আরেক দল আরেক পদ্ধতি আবিষ্কার করে চালালেন আরও কয়েক বছর। দেখা গেল এ পদ্ধতি তেমন ফল দিচ্ছে না সুতরাং আবার বদল। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। বলার অপেক্ষা রাখে না এর সঙ্গে রাজনৈতিক ওঠানামা বা ক্ষমতা বদলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। শিক্ষা নিয়ে এমন ছেলেখেলা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কিনা সন্দেহ। এত গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এত অর্থ ব্যয়ের পরও ঝরে পড়া বন্ধ হয়নি। তার কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের বেশিরভাগের জীবন আবর্তিত হয় প্রচ- অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায়। ঝরে পড়া এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এদের জীবনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার স্থায়ী সমাধানের কথা দেশী বিদেশী কোন গবেষকই বলেন না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর না করে ঝরে পড়া সম্পর্কে যত সদুপদেশ দেয়া হোক কাজের কাজ কিছুই হবে না। উনিশ শতকে সেই যে ব্যাবিংটন মেকলে বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন হুবুহু সে অনুযায়ী আজও চলছে শিক্ষিত ভদ্রলোকের সমাজ। যারা গণমানুষ থেকে নিজেদের সব সময় বিছিন্ন মনে করেন। ঔপনিবেশিক কূটবুদ্ধি খাটিয়ে এই শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর হাতে নিম্নবিত্তের শিক্ষার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন মেকলে। কিন্তু শিক্ষায় জ্ঞান গরিমায় বিকশিত হয়ে নিজেদের যারা দেশের ব্যাপক অধিকাংশ মানুষ থেকে উন্নত জাতের মানুষ ভাবেন তারা তাচ্ছিল্যভরে সে দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। যাদের দেখে নাক সিটকে দশ হাত দূরে থাকেন তাদের শিক্ষিত করা এদের পক্ষে সম্ভব নয় জেনেই মেকলে এ দায়িত্ব ওই শিক্ষিত এলিটদের ওপর দিয়েছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত হয়ে সাহিত্য দর্শন ইতিহাস ইত্যাদি চর্চায় উৎসাহিত হয়ে সমাজে আলোড়ন তুললেও এরা জাতীয় বুর্জোয়ার চরিত্র অর্জন করতে পারেননি। চরিত্রের এ রূপান্তর ঘটলে তাঁরা নিজেদের উন্নয়নকে গোটা জাতির উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ভাবতে পারতেন। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর সেখানকার বুর্জোয়ারা যেমন পেরেছিলেন। আমাদের এখানকার এলিট শ্রেণীর জন্ম সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ঔপনিবেশিক প্রভুর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এদের জন্ম হয়েছিল। চিরকাল তাঁরা প্রভুভক্ত থেকেছেন। ওই যে ব্রেনওয়াশ হয়েছিল তা থেকে বেরোতে পারছে না আজকের স্বাধীন বাংলাদেশও। বিচ্ছিন্নতার সেই ধারাটি এখনও সমান বহমান। একটি বুর্জোয়া সমাজ কাঠামো গঠনের জন্য যতটুকু দক্ষতা, প্রজ্ঞা, শিক্ষা ও উদারতা প্রয়োজন তা আজও অর্জিত হলো না। ভিন্ন ফর্মে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাই চলছে। প্রভুর প্রতি ভক্তিও এক চুলও টলেনি। পুঁজির অবাধ স্রোতে পথ হারিয়ে এখন তো লেজে গোবরে অবস্থা। এক দিকে উচ্চ শিক্ষার লাভজনক ব্যবসার রোশনাইয়ে চোখ ঝলসে যায়, অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত তলিয়ে আছে গভীর অন্ধকারে। বদ্ধ ডোবার মতো অবস্থা তার। মাঝে মাঝে নিরীক্ষার ঢিল পড়ে সামান্য ঢেউ ওঠে। দ্রুতই তা মিলিয়ে যায়। তারপর আবার ঘোর অন্ধকার। এমন অদ্ভুত এক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি দেশের পক্ষে কতটুকু এগুনো সম্ভব? অল্প কিছু মানুষ যাদের হাতে প্রচুর টাকা তারা তা দিয়ে সন্তানের জন্য শিক্ষা কিনছেন। তারা জনসংখ্যার কতভাগ? হয়ত দশ ভাগ কিংবা আরেকটু বেশি। কিন্তু বাকি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত কি। বছরখানেক আগে এক দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বলা হয়েছিল, প্রাথমিক স্তরে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ শিক্ষার্থী ভালভাবে শিখছে না। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাংলাই ভালভাবে পড়তে পারে না, গণিত ও ইংরেজীর অবস্থা আরও খারাপ। পঞ্চম শ্রেণীর শতকরা মাত্র পঁচিশ ভাগ শিশু বাংলায় এবং তেত্রিশ ভাগ গণিতে আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে। যার অর্থ শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ও সাতষট্টি ভাগ শিশু আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো এর পরও এসব শিশুর অনেকে উপরের শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবিষয়ক পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, যেসব শিক্ষার্থীর শেখার মাত্রা খারাপ তাদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। ঝরে পড়ার পর এক পর্যায়ে তারা অনানুষ্ঠানিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে। আরও বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, কী করে শিখছে এবং সামগ্রিকভাবে কতটুকু বুঝতে পারছে, তা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন শিক্ষকরা। এ শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। তারা বাধা ধরা পদ্ধতিতে মুখস্থ পড়ান। পড়ানোর বিষয়ে তাদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের শেখার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরনের গবেষণা অতীতে অনেক হয়েছে। সত্যি বলতে এতে নতুন কোন তথ্য উঠে আসে না। আসল সমস্যা অন্যখানে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বৈষম্য যে কত প্রকট প্রাথমিক অবস্থার চিত্র তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। শুধু এখন নয়। সমাজের নিচুতলার মানুষদের জন্য শিক্ষা সব সময়ই কষ্টকল্পিত ছিল। এক সময় বর্ণ প্রথার কঠিন অনুশাসনে সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ শূদ্ররা শিক্ষা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভারতীয় গুরুমুখী বিদ্যার বৈশিষ্ট্য হলো শুনে শেখা। গুরুর কাছে শুনে শিষ্য বেদ মুখস্থ করত। শুরু পরম্পরায় এ বিদ্যা টিকে থাকত। গুরুমুখী বিদ্যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিক্ষার অধিকার সীমাবদ্ধ রাখা। পাঠদানের লিখিত পদ্ধতি বা বই না থাকায় শূদ্ররা লুকিয়েও এ শিক্ষা নিতে পারত না। প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা এ চাতুরি করেছিল শোষণ প্রক্রিয়াকে সুসংহত রাখার জন্য। কিন্তু বেদ পাঠে অধিকার না পেলেও শূদ্রদের শিক্ষালাভের অধিকার শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে এখন বর্ণবৈষম্য না থাকলেও সব বৈষম্যের সেরা শ্রেণী-বৈষম্য প্রকটই আছে। একে ভেঙ্গে ফেলা চটজলদির কাজ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন সযতেœ টিকিয়ে রাখে যে সমাজ ব্যবস্থা সে সমাজের নিচের তলার মানুষদের জীবন আলোকিত করা সম্ভব কেবল ওই বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়েই। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে পারলে অন্যান্য অনিশ্চয়তাও দূর হবে। অন্ন সংস্থানের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারলে মনোযোগের পুরোটাই শিক্ষা অর্জনের পেছনে ব্যয় হবে। ঝরে পড়া তখন নিজ থেকেই বন্ধ হবে। সমস্যার আসল কারণ দূর না করে যত গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক কাজ যে কিছুই হয় না সাতচল্লিশ বছরে তা প্রমাণিত। রাষ্ট্র এবং সমাজের বৈষম্য রাতারাতি দূর করতে না পারলেও একে অন্তত সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। সে চেষ্টা আন্তরিকভাবে করলেই কেবল ওই বঞ্চিতদের জীবনমানের খানিক উন্নতি আশা করা যায়। নইলে যত সুন্দর বাক্য বিন্যাসই করা হোক এদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না।
×