ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

​​​​​​​ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল লাইন রেলপথ

৯ বছরেও হয়নি

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

৯ বছরেও হয়নি

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ

ভুল পরিকল্পনার কারণে বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। নির্মাণ জটিলতার কারণে কাজ শেষ না করে চলে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাই, প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করতে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হচ্ছে। ভুলের মাসুল দিতে গিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে ৮১ শতাংশ। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না হওয়ায় গত ছয় মাস নির্মাণ কাজ বন্ধ। ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষে পুরোপুরি কাজ শুরু করতে আরও তিন-চার মাস লাগবে বলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক . মো. সামছুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা-

নারায়ণগঞ্জের  মতো গুরুত্বপূর্ণ রেলপথটি ডাবল লাইন নির্মাণে অতিরিক্ত অর্থ, সময় জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী রেল কর্তৃপক্ষ। তাদের দূরদর্শিতার অভাবে ভুল পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এজন্য এখন ভুলের মাসুল দিতে হচ্ছে। শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, অন্য রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কাজ হচ্ছে। যেখানে ভারত অনেক আগেই ব্রডগেজ রেলপথে চলে গেছে। ২০২৩ সালে এসেও আমরা এখনো ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করছি। এর মানে অতিরিক্ত একটি রেলপথ নির্মাণ করা। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এর মূল কারণ ভুল পরিকল্পনা। এটা দেখার কেউ নেই। পরিকল্পনা কমিশন নামেমাত্র। এখানে কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। তাহলে এই ভুল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাসুল দিতে হতো না। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ১৪ কিলোমিটার রেলপথটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য যাত্রী পরিবহনের জন্য ১৮৮৫ সালে রেলপথটি নির্মাণ করে তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। তখনই রেলপথটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ডুয়েলগেজে উন্নতির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ১৩৮ বছর পরও ঢাকা-নারায়গঞ্জ রেলপথ ডবললাইন নির্মাণ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৪ সালেঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণপ্রকল্প গ্রহণ করে রেলওয়ে। বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে না পারলে চলমান ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ শেষে এর সুফলও আসবে না। দুই লাইনের নানা সমস্যা রয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের সময়ই পরিকল্পনায় ভুল ছিল। বর্তমানে নির্মিত ডুয়েলগেজের চেয়ে প্রায় তিন ফুট নিচুতে রয়েছে চলমান মিটারগেজ লাইনটি। দুই লাইনের একটা উঁচু, একটা নিচু হওয়ায় ট্রেন চলাচলে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি হলে চলমান লাইনটিতে পানি জমছে। অন্যদিকে দুটি লাইনের মাঝে লেভেলক্রসিং সমান্তরাল না হওয়ায় সড়কে যান চলাচলে বিঘœ হচ্ছে। তাই পুরাতন লাইনটি ডুয়েলগেজে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য সংশোধন করা হয় ডিপিপি। এতে প্রকল্পের ব্যয় সময় দুটি বেড়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। ২০১২ সালে প্রকল্পটির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে সময় একই সঙ্গে পথে ডুয়েলগেজের দুটি লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তা গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্টরা। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন কয়েক বছর আগেই বিদ্যমান ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মিটারগেজ রেলপথটি সংস্কার করা হয়েছে। এমন যুক্তির পর শুধু নতুন একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হয়।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার রেললাইনকে ডুয়েলগেজ  নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালে জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজের জন্য রেলপথটি ১৪ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১২ কিলোমিটার করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ চার দফা বৃদ্ধি ব্যয় এক দফা বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারিঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণপ্রকল্প অনুমোদন করে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপানের অনুদানের অর্থ রয়েছে ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বাকি ১২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়।

পরবর্তী সময় আরডিপিপিতে প্রকল্পের ব্যয় ৩০৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এতে প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৫৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৮১ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। তবে প্রকল্পটির বাড়তি টাকা দিতে রাজি হয়নি জাপান। ফলে ৪০৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। পর্যন্ত প্রকল্পের ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সেলিম রউফ জনকণ্ঠকে বলেন, চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এই রেলপথের ডবললাইন করতে হলে ১২ শতাংশ জমির প্রয়োজন। জমিটি দিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন সম্মত হয়েছে। তাই ডবললাইন নির্মাণে আর কোনো সমস্যা হবে না। এছাড়া বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনটি নতুন করে ডুয়েলগেজে নির্মাণ করার জন্য প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের মেয়াদ ব্যয় বেড়ে গেছে। আগে প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বর্তমানে তা ৬৫৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। এর মধ্যে জাপানের অনুদানের অর্থ রয়েছে ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বাকিটা সরকারের ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে।

কাজ না করে চলে গেছে ঠিকাদার  ॥ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণপ্রক্ল্প একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পটি নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়নার (পিসিসিসি) সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। আনুষঙ্গিক কাজের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি নতুন স্টেশন ভবন প্ল্যাটফর্ম, একটি অফিস কাম স্টেশন ভবন, ১১টি ব্রিজ কালভার্ট, চারটি পথচারী সেতু, সীমানা প্রাচীর দুটি ওয়াশ পিট নির্মাণ। ছাড়া প্রকল্পের আওতায় রয়েছে জুরাইন রেলগেট থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ১২ দশমিক শূন্য কিলোমিটার প্রধান লাইন, পাঁচ কিলোমিটার লুপলাইনসহ কিছু আনুষঙ্গিক কাজ। জুরাইন রেলগেট থেকে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত অবশিষ্ট চার কিলোমিটার নির্মাণকাজ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় করা হচ্ছে।

জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার অযুহাতে গত মার্চ থেকে প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয় চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিসিসিসি। প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখে গত ১৫ মার্চ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিসিসিসি যথাসময়ে পাওনা পরিশোধ না করা, অতিরিক্ত কাজের মূল্য পরিশোধ না করা কাজের এলাকা বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষকে কাজের চুক্তি সমাপ্তির নোটিস দেয়। এর জবাবে ২৩ মার্চ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ঠিাকাদারকে পত্র পাঠালেও এর কোনো জবাব আসেনি। সর্বশেষ গত মে মাসে চুক্তি বাতিল করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিসিসিসি। নিয়ে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হলেও কোনো সমাধান হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

প্রকল্প পরিচালক সেলিম রউফ জনকণ্ঠকে বলেন, গত মে মাসে চলে গেছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিসিসিসি। এর পর প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। ২০১৭ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী লোয়েস্ট বিডার হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন তারা। কাজ নেওয়ার পর জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েছে। তারা খরচ বৃদ্ধির জন্য আমাদের কাছে একটা আবেদন করেছে। এটা বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, তারা সবচেয়ে কম দর দেখিয়েই কাজ নিয়েছে। তাই এখন নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না করা পর্যন্ত কাজ শুরু করা যাবে না। ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানান তিনি।

রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডুয়েলগেজ করার জন্য যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল বিভিন্ন সমস্যার কারণে কন্ট্রাক্টর কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ডুয়েলগেজ প্রকল্প রিভাইজ করে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন করে টেন্ডারিং করে আমারা দ্রুত কাজ শুরু করব এবং আশা করি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব।

 

×