বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু
বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রত্যাশার ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সফরের দ্বিতীয় দিন বুধবার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, আমরা সামনে তাকাতে চাই। পেছনের দিকে নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায় বলে উল্লেখ করে ডোলান্ড লু বলেন, গত বছর, আমাদের এবং বাংলাদেশের মধ্যে অনেক উত্তেজনা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচনের জন্য খুব কঠোর পরিশ্রম করেছে। এর ফলে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল।
সেই অস্বস্তি কাটিয়ে ওয়াশিংটন আর পেছনে নয়, সামনের দিকে তাকাতে চায়। আমরা আমাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে চাই। তাই আমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার কথা বলেছি।
এর আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সাংবাদিকদের ডোনাল্ড লু বলেন, সম্পর্ক পুনর্গঠনে আমি ঢাকা এসেছি। আমরা আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে চাই।
ডোলান্ড লু বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, শ্রম সংস্কার, মানবাধিকার, ব্যবসায়িক জলবায়ু সংস্কারের মতো কঠিন ইস্যু আছে দুই দেশের মধ্যে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা গড়ে তুলতে চায় বলে জানিয়েছেন তিনি।
একইসঙ্গে বাংলাদেশে নতুন নতুন বিনিয়োগ, বাংলাদেশী শিক্ষার্থী যারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আগ্রহী এবং ক্লিন এনার্জি নিয়ে কাজের বিষয়ে আমরা কথা বলেছি বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা, কর্মকর্তাদের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং করের আওতা বাড়াতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায় বলেও জানান তিনি।
এদিকে বুধবার ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের এক পোস্টে লেখা হয়েছে, সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে তোলা, কর্মশক্তি বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সহযোগিতার উন্নতি, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমাদের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের যৌথ অঙ্গীকারকে পুনর্ব্যক্ত করেছে,’ লেখা হয় ওই পোস্টে।
ডোলান্ড লু’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে মুখোমুখি হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসাবে ইতিবাচক বিষয়েই আলাপ হয়েছে তাদের; যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে বিনিয়োগ, বাণিজ্যসহ যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়গুলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি সম্পর্ককে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। সেই অভিপ্রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। আমাদের আলোচনা সে লক্ষ্যেই হয়েছে।
তিনি বলেন, একক দেশ হিসেবে আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশও যুক্তরাষ্ট্র। আমি ডোনাল্ড লুকে অনুরোধ জানিয়েছি, বাংলাদেশে ৪০টি আইটি ভিলেজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে সেখানে যেন যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ বাড়ায়। যদিও কিছু বিনিয়োগ তারা এরই মধ্যে করেছে।
ড. হাছান আরও বলেন, ডোনাল্ড লু বলেছেন আমাদের ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য। যে জিএসপি সুবিধা আমরা আগে পেতাম এখন পাই না, সেটি তারা ফিরিয়ে দিতে চায়। জিএসপি সুবিধা তারা পুনর্বহাল করলে বাংলাদেশকে আবার দিতে চায়। তবে সেটি এখনো পুনর্বহাল হয়নি। সেজন্য আমাদের শ্রম আইন একটু সংশোধন করতে হবে, যেটি আমরা সংশোধনের চেষ্টা করছি। সেটি নিয়ে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রীর সঙ্গে তার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশেষত আমাদের রিজার্ভ শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে বাংলাদেশকে অর্থায়ন করতে চায়। একই সঙ্গে আমাদের কর আদায়ের পদ্ধতিকে আধুনিক করতেও সহায়তা দিতে চায় তারা। কর ফাঁকি বন্ধে কর আহরণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সহায়তা করতে চায়। এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা তাদের সহায়তা চেয়েছি।
‘তিনি (ডোনাল্ড লু) বলেছেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিস্তৃত করার জন্য তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করেছি’- বলেন তিনি।
হাছান মাহমুদ আরও বলেন, বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা যেন আরও ব্যাপকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারে, উচ্চতর পড়াশোনা করতে পারে এবং নারীর ক্ষমতায়নেও তারা আমাদের সহায়তা করতে চায়। আমি একটি প্রস্তাব দিয়েছি যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যেন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করা হয়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করতে চায়, আমরাও চাই। লু সম্পর্ক এগিয়ে নিতেই এ সফরে এসেছেন। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।
ডোলান্ড লু’র সঙ্গে বৈঠকে ভিসানীতি নিয়ে এর আগে দুপুরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে করেন ডোনাল্ড লু। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনে অংশ নেন তিনি। এই বৈঠক গণমাধ্যমে কথা বলেন তিনি। এরপরে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে পদ্মা ছেড়ে যান।
পরিবেশ মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ সফররত ডোলান্ড লু’র দ্বিতীয় দিনের সকালে শুরুতেই বৈঠক করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে। বৈঠক শেষে ডোলান্ড লু বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, অতীত নয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয়েছে।
তিনি বলছেন, ডোলান্ড লু’র সঙ্গে অতীতের কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়নি। আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছি। সামনের দিকে সম্পর্ককে কীভাবে আরও সুদৃঢ় করব সেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
সাবের হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আছে; আগামী দিনে এটাকে কীভাবে আরও এগিয়ে নিতে পারি এবং সেখানে স্বাভাবিকভাবে যে বিষয়গুলোতে আমাদের অবস্থান ভিন্ন, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ও সেটার অভিঘাত মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আমেরিকা আরও কীভাবে কাজ করতে পারে, মূলত আমরা সেটা নিয়ে আলাপ করেছি।
সাবের হোসেন বলেন, যখনই আমরা জলবায়ু নিয়ে কথা বলি; পরিবেশের বিষয়টা চলে আসে। আমাদের আগামী দিনের যে সহযোগিতা, সেটাকে আমরা একটা কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করব। আমাদের ওয়ার্কিং গ্রুপের মতো কিছু একটা থাকতে পারে। আমরা তিন, চার অথবা পাঁচ বছরের একটা কর্মসূচি নেব। প্রতিবছর সেই কর্মসূচির অধীনে আমরা কী কী কাজ করব, সেটা থাকবে।
তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়নের যে বিষয়টা আছে, সেখানে বিশেষ করে বিশ্ব ব্যাংক আছে, এডিবি আছে, আগামী দিনে তারা কীভাবে অর্থায়ন করবে জলবায়ুতে, সেটা একটা বড় বিষয়। কেননা, আমরা যদি প্যারিস চুক্তির আলোকে দেখি সেখানে চাহিদাটা ছিল বিলিয়ন ডলারের। এখন চাহিদা চলে যাচ্ছে ট্রিলিয়ন ডলারে। বিশাল এই অর্থ তো কোনো সরকারের কাছ থেকে আসবে না। আসবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাত থেকে।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের কিছু বিষয় আছে যার একটা স্থায়িত্ব থাকে। আবার কিছু কিছু বিষয় তৈরি হতে পারে যেটা বিশেষ একটা প্রেক্ষাপটে। আমরা আজ যেটা আলাপ করেছি আমাদের যে মৌলিক বিষয়গুলো আছে, যেগুলো আমরা মনে করি অভিন্ন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি।
সাবের হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে তাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাদের হয়ত কিছু অস্বস্তি ছিল; কিন্তু সেটা তো আমাদের মধ্যে ছিল না। আমরা আমাদের নির্বাচন করেছি। সেটা ওই সময়ের জন্য তাদের একটা অবস্থান ছিল। আমি এভাবে দেখি। এখন তো ওই পর্বটা নেই। আবার নির্বাচন হবে ৪ বা সাড়ে ৪ বছর পরে। এখন তো নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় আসার কথা নয়। আর আমি প্রথমেই বলেছি, আমরা সামনের দিকে কীভাবে আমাদের সম্পর্কটাকে আরও সুদৃঢ় করব, সেটা নিয়েই মূলত আলোচনা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের জন্য লু’র শুভ কামনা ॥ বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন ঢাকায় সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বুধবার বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে তিনি এ শুভকামনা জানান। সেখানে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সঙ্গে এক প্রীতি ম্যাচে অংশ নেন ডোনাল্ড লু ও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
ম্যাচ শেষে ডোনাল্ড লু সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নারী ক্রিকেট দলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছি। বাংলাদেশের জনগণ ক্রিকেট পাগল। যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট সিরিজের আয়োজন করতে পেরে সন্তুষ্ট। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন করছে বলে আমরা খুব খুশি। তিনি বলেন, বুধবারের প্রীতি ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। তিনি একজন বিশ্বমানের আম্পায়ার।
তিনি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, এটি আমাদের জন্য আনন্দের। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দলের জন্য আমাদের শুভ কামনা রইল। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল যুক্তরাষ্ট্রে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে বুধবার রাতে ঢাকা ছাড়বে।
বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে পৌঁছলে ডোনাল্ড লু ও পিটার হাসকে জার্সি ও ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। তাদের শুভেচ্ছা জানান বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান। এ সময় নারী ক্রিকেট দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ১৪ মে তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন।