ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

এক বছরে ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, পাঠদান ব্যাহত

বিরূপ প্রভাব শিক্ষায় ॥ জলবায়ু পরিবর্তন

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৪ মে ২০২৩

বিরূপ প্রভাব শিক্ষায় ॥ জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে শুধু এক বছরে বিভিন্ন মেয়াদে দেশের ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে শুধু এক বছরে বিভিন্ন মেয়াদে দেশের ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ২০২১ সালে বন্যা, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙনসহ অন্তত ১০ কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঠদান, যা চরম প্রভাব পড়েছে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেক এলাকায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার একটি নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে ও শিখন ঘাটতি পূরণে পরিকল্পনার অভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ও শিশুশ্রম বাড়ছে। একইসঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও পানির স্তর এবং পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে সাধারণ মানুষের জীবনের আয় ও জীবিকাতে। এর থেকে বাঁচতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে পৃথক শিক্ষা ক্যালেন্ডার করার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করোনার কারণে ৫৪৪ দিন পর  খোলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ভয়ানক প্রভাব পড়ে পাঠদান ও শিক্ষা ব্যবস্থায়। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, করোনার কারণে প্রথম এক বছরে পৃথিবীজুড়ে প্রায় সতেরো কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দশ কোটি শিশুই ছিল ১৪টি দেশের, যেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালে বেসরকারি পর্যায়ে ৯ হাজার ৫১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে ৮ম গ্রেডের প্রাথমিকের ৪৬টি, জুনিয়র পর্যায়ের স্কুল ২০১টি, দেড় হাজারের বেশি সেকেন্ডরি স্কুল, ১২১টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ২৭৭টি কলেজ ও ৯১৪টি মাদ্রাসা রয়েছে। অন্যদিকে একই কারণে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় ৪৫৯টি। এর মধ্যে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম গ্রেডের তিন প্রাথমিক, ৬৫টি মাধ্যমিক স্কুল, ১১টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৬১টি সরকারি কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে আরও তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ বছর বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় এলাকায় লবণক্ততা বৃদ্ধির কারণে। লবণাক্ততার কারণে বেসরকারি পর্যায়ের প্রায় তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ১২৮টি স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ের মাদ্রাসা ৮৬২টি, ২১৮টি কলেজ, ১৫৪৭ টি মাধ্যমিক স্কুল ও ২১৫টি জুনিয়র স্কুল রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে লবণাক্ততার কারণে ১৩টি মাধ্যমিক স্কুল, ১টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ১০টি কলেজ বন্ধ করা হয়।
একই বছর বন্যার কারণে সরকারি পর্যায়ে ৪৬টি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৩২৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে জুনিয়র সেকেন্ডারি পর্যায়ে ৮৯টি বেসরকারি স্কুল, সেকেন্ডারি ১২টি সরকারি স্কুল ও বেসরকারি ৬৭৪টি স্কুল, ৮টি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ১৮টি সরকারি কলেজ ও ১০৯টি বেসরকারি কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া ৪২০টি মাদ্রাসা বন্ধ করার মতো ঘটনা ঘটেছে।
নদীভাঙনেও প্রায় ৮১২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে ৮ম সংযুক্ত ১৬টি প্রাথমিক  বিদ্যালয়, ৪৮টি জুনিয়র স্কুল, ১৩টি সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল ৪৪৬টি, একটি সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৩৫টি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ১০টি সরকারি কলেজ ও ৫৯টি বেসরকারি কলেজ ও ২২৪টি বেসরকারি মাদ্রাসা ও ৪০টি সরকারি মাদ্রাসা আছে।
এর পরেই আছে পাহাড় ধসের ঘটনা। এই ঘটনায় এক বছরে ৬৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৪২টি জুনিয়র স্কুল, তিনটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল, ১০৮টি মাধ্যমিক স্কুল, একটি সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাতটি সরকারি কলেজ ও ২৫২টি বেসরকারি মাদ্রাসা ও ১৯টি সরকারি মাদ্রাসা অন্যতম। একইভাবে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সরকারি ও বেসরকারি ২৬৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০২১ সালে বন্ধ ছিল। এর মধ্যে আটটি সরকারি মাদ্রাসা, ৮৫টি বেসরকারি মাদ্রাসা, ১৮টি সরকারি কলেজ, ১দুটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল, ৬৭৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল অন্যতম। এ ছাড়া তীব্র স্রোত, খরা, ঢেউ ও ভূমিকম্পের মত ঘটনাতেও শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব যেভাবে পড়ছে শিক্ষায় ॥ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল খুলনা ও সাতক্ষীরার বেশকিছু উপজেলা কয়েক বছর ধরে লবণাক্ততা বেড়েছে ও জোয়ারের পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে এসব অঞ্চলে শিক্ষা তো বটেই জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। 
এ বিষয়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক কে এম এনামুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, এসব এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে অধিকাংশ পুরুষ জীবিকা হারাচ্ছেন। অনেকে আবার অন্য জেলাতে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। অধিকাংশ মানুষ পরিবার রেখে অন্য জেলায় যেমন ভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন আবার সেখানে বিয়ে করে নতুন পরিবার তৈরি করায় উপকূলীয় এলাকার নারী ও শিশুরা সামজিকভাবেও হুমকির মধ্যে পড়ছে। এর ফলে সেখানকার নারী শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে যেসব শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রণোদনা বা সুযোগ সুবিধা এখনো চালু হয়নি। তবে প্রাকৃতিক কারণে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামতের জন্য সরকারের একটি বরাদ্দ রয়েছে।
যা বলছেন শিক্ষাবিদরা ॥ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যখন শিক্ষায় পড়ছে এর অর্থ আমাদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে আর্থিক ত্রাণ পাই, তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দুই মন্ত্রণালয় থাকায় বিষয়গুলো কম গুরুত্ব পচ্ছে বলে মনে করেন ব্রাক বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। তার মতে শিক্ষার সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর ঢাকায় হওয়ায় এই ধরনের পরিস্থিতি কম অনুধাবন করা হয়।  জনকণ্ঠকে এই শিক্ষাবিদ বলেন, দিনে দিনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা আরও বাড়ছে। এ বিষয়ে এখন থেকেই সঠিক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এরসঙ্গে সরকারকে অর্থায়নও করতে হবে। না হলে ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলছি তা হোঁচট খাবে। শিক্ষা খাতও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় মিলেছে সত্যতা ॥ ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সম্প্রতি একদল গবেষক ২৯টি ভিন্ন দেশ থেকে জলবায়ু এবং জনসমীক্ষার রিপোর্টে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই প্রায় আড়াই ডজন দেশ থেকে প্রায় ১ কোটি ৩৮ লক্ষ শিশুর তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। এতে চরম তাপমাত্রা এবং জলবায়ুর পরিবর্তন প্রতিকূলতা হিসেবে শিশুর স্কুল শিক্ষাকেও প্রভাবিত করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঘুর্ণিঝড়, খরা, বন্যা ও নদীভাঙনের মতো প্রভাবের শিকার হওয়ার অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) নতুন এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তান।
ইউনিসেফ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের এ ধরনের প্রতিবেদন এটাই প্রথম। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শিশুরা দাবদাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই চারটি দেশের শিশুদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা হুমকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু সংকট মূলত শিশু অধিকারের সংকট বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ। শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনে দেশগুলোকে ক্রমানুসারে স্থান দেওয়া হয়েছে। 
দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার লাখো শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ুদূষণ ও নদীভাঙনের কারণে লাখো শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত, স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

×