ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ ঘিরে ব্যস্ত কামারশালা

লোহা পেটানোর আওয়াজ, কয়লা পোড়ানোর গন্ধ

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ৬ জুলাই ২০২২

লোহা পেটানোর আওয়াজ, কয়লা পোড়ানোর গন্ধ

টুংটাং শব্দে মুখরিত কামারপাড়া

বেজায় ভদ্রলোকটিও এখন ছুরি-চাকুর খোঁজ করছেনদিব্যি হাতে তুলে নিচ্ছেন চাপাতি, চাইনিজ কুড়ালআঙ্গুল দিয়ে এসব দেশীয় অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করছেনঅন্য সময় এমন দৃশ্য দেখলে হৈ চৈ পড়ে যেতকিন্তু এখন তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেইযেন খুব স্বাভাবিক ছবিআসলেই স্বাভাবিককারণ কোরবানির ঈদ সামনেআগামী রবিবার সারাদেশে উদ্যাপিত হবে ঈদ-উল-আজহাএরই মাঝে রাজধানীতে জমে উঠেছে পশুর হাটদেদার কেনা বেচা হচ্ছে গরু ছাগল ভেড়া বকরিসবই কোরবানি হবেআর এ কোরবানির কাজে প্রয়োজন হবে বিভিন্ন রকমের ছুরি চাকুদা বঁটি ছুরি চাকু সবই এখন প্রয়োজনীয় উপকরণচাহিদা একেবারে তুঙ্গেদিন রাত কাজ হচ্ছে কাওরান বাজারের কামারশালায়লোহা পেটানোর শব্দকয়লার আগুনস্ফুলিঙ্গহাঁপরের আওয়াজসব মিলিয়ে চোখে পড়ার মতো কর্ম চাঞ্চল্য

যতদূর তথ্য, গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে দা বঁটি ছুরি চাকু ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি হচ্ছেসিটি কর্পোরেশনের অনুমোদিত কামারশালা আছে এক ডজনের মতোআর সব মিলিয়ে প্রায় ৩০টি দোকানসবগুলো দোকান পাশাপাশিসামনের দিকে ছুরি চাকু চাপাতির মতো ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে।  হঠা দেখে পিলে চমকে যায়আর এর ঠিক পেছনে কামারশালাসেখানে কয়লা দিয়ে ছোট ও নিয়ন্ত্রিত আগুন জ্বালানো হচ্ছেদীর্ঘ সময় আগুনে পুড়ে  লোহা কিছুটা নমনীয় হতেই তাতে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হচ্ছেএভাবে পুড়ে পিটিয়ে বাঁকা করে সোজা করে তৈরি করা হচ্ছে কোরবানির ছুরি চাকুপরে জলে চুবিয়ে নিয়ে সেগুলো তোলা হচ্ছে দোকানের সামনের অংশে

বুধবার নিজের কামারশালায় লোহা পুড়িয়ে পিটিয়ে চাপাতি তৈরি করছিলেন দীপক নামের এক কামারমাঝবয়সী ব্যক্তি মেঝেতে বসে বিশেষ কায়দায় লোহা পোড়াচ্ছিলেনভীষণ লাল হয়ে যাওয়ার পর লৌহখ-টি তুলে আনেন তিনিতার পর একসঙ্গে তিনজন হ্যামার দিয়ে এটিকে পেটাতে থাকেনচোখের সামনেই প্রস্তুত হয়ে যায় চাপাতিএকই নিয়মে চলছিল ছুরি তৈরির কাজ

কাজের ফাঁকে দীপক বললেন, কামারশালা সারাবছরই চলেকম বেশি কাজ হয়তবে কোরবানির ঈদে ছুরি চাকুর চাহিদা অনেক বেড়ে যায়এবারও অনেক আগেই কাজ শুরু করেছিলাম আমরাএখনও দিন রাত কাজ করছিবিক্রিও বেশ ভাল বলে জানান তিনি

আরেক কামার আল আমিন জানান, গরু কোরবানি ও মাংস কাটা বাছার কাজ করতে মোটামুটি ছয় জাতের ছুরি দরকার হয়একেকটির একেক কাজকাজের কথা মাথায় রেখেই কাজ করছেন বলে জানান তিনিকাওরান বাজারের দোকানগুলোতে সব ধরনের ছুরি সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখনবড় ছুরিটির নাম জবাই ছুরিপশু জবাই করার জন্য বিশেষ উপযোগী করে বানানোদোকানিরা জানান, এ কারণেই ছুরিটির নাম জবাই ছুরি১৮ থেকে ২২ ইঞ্চির মতো লম্বাসামনের অংশ হাতির সুরের মতো বাঁকানোকিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেছে

সাধারণ জবাই ছুরির দাম ৫০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যেতবে কিছু জবাই ছুরির দাম অনেক বেশিউদাহরণ হতে পারে সৌদি তলোয়ারএর গঠন, বিশেষ করে হাতলটা সৌদি আরবের তলোয়ারের মতো দেখতেতাই সৌদি তলোয়ার নামআর দাম? মনির নামের এক দোকানি অবাক করে দিয়েই বললেন, ‘ধরেন যে, ৭০০০ টাকাএই দামে এরই মাঝে চার পাঁচটা বিক্রি করেছেন বলেও জানান তিনি

পশু জবাইয়ের পরের কাজটি চামড়া ছাড়ানোএ কাজ একটু সতর্কতার সঙ্গে করা চাইএ জন্য বিশেষ এক ধরনের ছোট ছুরি তৈরি করা হয়েছেশাকিব নামের এক বিক্রেতা জানান, চামড়া ছাড়ানোর কাজে যে ছুরি ব্যবহার করা হয় সেটির নাম ছিলা ছুরিচামড়া ছাড়ানোর কাজটি একসঙ্গে চারজন বা ততোধিক ব্যক্তি করে থাকেনএ জন্য ছিলা ছুরিকয়েকটা কেনাই নিয়মদাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে

মাঝারি সাইজের ছুরিটির নাম আবার সাইজ ছুরিকামারদের ব্যাখ্যা, এ ছুরি দিয়ে মাংস কুপিয়ে সাইজকরা হয়একে তাই সাইজ ছুরিবা কোপ ছুরিবলা হয়কোন কোন দোকানি আবার এটিকে বলেন কামেলা ছুরিএ ছুরির দাম ১০০ থেকে ৫০০ টাকাগরুর হাড় কেটে ছোট করার কাজে চাপাতি ব্যবহার করা হয়তাই বিভিন্ন আকারের চাপাতি তৈরি করা হয়েছে

কেউ কেউ রেল লাইনের রেল দিয়ে চাপাতি তৈরি করেছেনখুব মজবুত এবং  ধারালোদেড় কেজির মতো ওজন৭০০ থেকে ১০০০ টাকা দামআছে গাড়ির স্প্রিংয়ের তৈরি চাপাতিওঅভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় চাইনিজ কুড়ালএ কুড়াল খুব চকচকেকাঠের হাতলদাম ৮০০ থেকে ১২০০ টাকাএসবের বাইরে প্রায় সবকটি কামারশালার সামনের অংশে বিপুল সংখ্যক দা বঁটি সাজিয়ে রাখা হয়েছেবিশাল বিশাল দা বঁটিদেখে বোঝা যায়, এগুলো বেশি বিক্রি হয়তৈরিও হয় বেশি সংখ্যায়

ক্রেতারাও অভাব নেইকেউ কোরবানির পশু কেনার পর ছুরি কিনতে আসছেনকেউ ছুরি কিনতে আসছেন পশু কেনার আগেইমিরপুর থেকে আসা এক ক্রেতা, নাম তুহিন, নিজের ব্যবসা করেনবলছিলেন, গরু কেনা হয়ে গেছেবড়সড় গরুভাল ছুরি না হলে পশুর কষ্ট বেশি হবেতাই মজবুত ও ধারালো ছুরি কিনতে এখানে এসেছিএখানে অনেক আছেদেখে নেয়া যায়এ কারণেই কাওরান বাজারে আসা বলে জানান তিনি

আবদুল হামিদ মুর্শিদ নামের এক ক্রেতাকে পাওয়া গেল, যিনি আবার পেশায় শিক্ষকএকটি বেসরকারী কলেজে পড়ানকথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কোরবানির ছুরি কেনার লোক আছে আমারকিন্তু সে এখন করোনায় আক্রান্ততাই নিজে এসেছিঅভিজ্ঞতা মিশ্রএখানে যেভাবে ধারালো সব অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেখে যে কারও পিলে চমকে যাবে

আমার নিজেরও রীতিমতো ভয় লাগছেতবে কামারশালায় যারা কাজ করছেন তাদের দেখে গ্রামের স্মৃতি মনে পড়ে গেছে বলে জানান তিনিবলেন, কামারদের পেশা অনেক প্রাচীনরাজধানীতে এখনও এই পেশা টিকে আছে দেখে ভাল লাগছে

কোরবানির জন্য ছুরি কিনলেও, তিনি বলেন, মনের পশুকেই জবাই করতে হবে আগেএটাই সবচেয়ে বেশি জরুরীকোরবানির ঈদ থেকে মহ হওয়ার এ শিক্ষা সবার নেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি

×