টুংটাং শব্দে মুখরিত কামারপাড়া
বেজায় ভদ্রলোকটিও এখন ছুরি-চাকুর খোঁজ করছেন। দিব্যি হাতে তুলে নিচ্ছেন চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল। আঙ্গুল দিয়ে এসব দেশীয় অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করছেন। অন্য সময় এমন দৃশ্য দেখলে হৈ চৈ পড়ে যেত। কিন্তু এখন তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যেন খুব স্বাভাবিক ছবি। আসলেই স্বাভাবিক। কারণ কোরবানির ঈদ সামনে। আগামী রবিবার সারাদেশে উদ্যাপিত হবে ঈদ-উল-আজহা। এরই মাঝে রাজধানীতে জমে উঠেছে পশুর হাট। দেদার কেনা বেচা হচ্ছে গরু ছাগল ভেড়া বকরি। সবই কোরবানি হবে। আর এ কোরবানির কাজে প্রয়োজন হবে বিভিন্ন রকমের ছুরি চাকু। দা বঁটি ছুরি চাকু সবই এখন প্রয়োজনীয় উপকরণ। চাহিদা একেবারে তুঙ্গে।দিন রাত কাজ হচ্ছে কাওরান বাজারের কামারশালায়। লোহা পেটানোর শব্দ। কয়লার আগুন। স্ফুলিঙ্গ। হাঁপরের আওয়াজ। সব মিলিয়ে চোখে পড়ার মতো কর্ম চাঞ্চল্য।
যতদূর তথ্য, গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে দা বঁটি ছুরি চাকু ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদিত কামারশালা আছে এক ডজনের মতো। আর সব মিলিয়ে প্রায় ৩০টি দোকান। সবগুলো দোকান পাশাপাশি। সামনের দিকে ছুরি চাকু চাপাতির মতো ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ দেখে পিলে চমকে যায়। আর এর ঠিক পেছনে কামারশালা। সেখানে কয়লা দিয়ে ছোট ও নিয়ন্ত্রিত আগুন জ্বালানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় আগুনে পুড়ে লোহা কিছুটা নমনীয় হতেই তাতে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। এভাবে পুড়ে পিটিয়ে বাঁকা করে সোজা করে তৈরি করা হচ্ছে কোরবানির ছুরি চাকু। পরে জলে চুবিয়ে নিয়ে সেগুলো তোলা হচ্ছে দোকানের সামনের অংশে।
বুধবার নিজের কামারশালায় লোহা পুড়িয়ে পিটিয়ে চাপাতি তৈরি করছিলেন দীপক নামের এক কামার। মাঝবয়সী ব্যক্তি মেঝেতে বসে বিশেষ কায়দায় লোহা পোড়াচ্ছিলেন। ভীষণ লাল হয়ে যাওয়ার পর লৌহখ-টি তুলে আনেন তিনি। তার পর একসঙ্গে তিনজন হ্যামার দিয়ে এটিকে পেটাতে থাকেন। চোখের সামনেই প্রস্তুত হয়ে যায় চাপাতি। একই নিয়মে চলছিল ছুরি তৈরির কাজ।
কাজের ফাঁকে দীপক বললেন, কামারশালা সারাবছরই চলে। কম বেশি কাজ হয়। তবে কোরবানির ঈদে ছুরি চাকুর চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এবারও অনেক আগেই কাজ শুরু করেছিলাম আমরা। এখনও দিন রাত কাজ করছি। বিক্রিও বেশ ভাল বলে জানান তিনি।
আরেক কামার আল আমিন জানান, গরু কোরবানি ও মাংস কাটা বাছার কাজ করতে মোটামুটি ছয় জাতের ছুরি দরকার হয়। একেকটির একেক কাজ। কাজের কথা মাথায় রেখেই কাজ করছেন বলে জানান তিনি। কাওরান বাজারের দোকানগুলোতে সব ধরনের ছুরি সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখন। বড় ছুরিটির নাম জবাই ছুরি। পশু জবাই করার জন্য বিশেষ উপযোগী করে বানানো। দোকানিরা জানান, এ কারণেই ছুরিটির নাম জবাই ছুরি। ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চির মতো লম্বা। সামনের অংশ হাতির সুরের মতো বাঁকানো। কিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেছে।
সাধারণ জবাই ছুরির দাম ৫০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। তবে কিছু জবাই ছুরির দাম অনেক বেশি। উদাহরণ হতে পারে ‘সৌদি তলোয়ার।’ এর গঠন, বিশেষ করে হাতলটা সৌদি আরবের তলোয়ারের মতো দেখতে। তাই সৌদি তলোয়ার নাম। আর দাম? মনির নামের এক দোকানি অবাক করে দিয়েই বললেন, ‘ধরেন যে, ৭০০০ টাকা।’ এই দামে এরই মাঝে চার পাঁচটা বিক্রি করেছেন বলেও জানান তিনি।
পশু জবাইয়ের পরের কাজটি চামড়া ছাড়ানো। এ কাজ একটু সতর্কতার সঙ্গে করা চাই। এ জন্য বিশেষ এক ধরনের ছোট ছুরি তৈরি করা হয়েছে। শাকিব নামের এক বিক্রেতা জানান, চামড়া ছাড়ানোর কাজে যে ছুরি ব্যবহার করা হয় সেটির নাম ‘ছিলা ছুরি।’ চামড়া ছাড়ানোর কাজটি একসঙ্গে চারজন বা ততোধিক ব্যক্তি করে থাকেন। এ জন্য ‘ছিলা ছুরি’ কয়েকটা কেনাই নিয়ম। দাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।
মাঝারি সাইজের ছুরিটির নাম আবার ‘সাইজ ছুরি।’ কামারদের ব্যাখ্যা, এ ছুরি দিয়ে মাংস কুপিয়ে ‘সাইজ’ করা হয়। একে তাই ‘সাইজ ছুরি’ বা ‘কোপ ছুরি’ বলা হয়। কোন কোন দোকানি আবার এটিকে বলেন কামেলা ছুরি। এ ছুরির দাম ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। গরুর হাড় কেটে ছোট করার কাজে চাপাতি ব্যবহার করা হয়। তাই বিভিন্ন আকারের চাপাতি তৈরি করা হয়েছে।
কেউ কেউ রেল লাইনের রেল দিয়ে চাপাতি তৈরি করেছেন। খুব মজবুত এবং ধারালো। দেড় কেজির মতো ওজন। ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা দাম। আছে গাড়ির স্প্রিংয়ের তৈরি চাপাতিও। অভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় চাইনিজ কুড়াল। এ কুড়াল খুব চকচকে। কাঠের হাতল। দাম ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। এসবের বাইরে প্রায় সবক’টি কামারশালার সামনের অংশে বিপুল সংখ্যক দা বঁটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিশাল বিশাল দা বঁটি। দেখে বোঝা যায়, এগুলো বেশি বিক্রি হয়। তৈরিও হয় বেশি সংখ্যায়।
ক্রেতারাও অভাব নেই। কেউ কোরবানির পশু কেনার পর ছুরি কিনতে আসছেন। কেউ ছুরি কিনতে আসছেন পশু কেনার আগেই। মিরপুর থেকে আসা এক ক্রেতা, নাম তুহিন, নিজের ব্যবসা করেন। বলছিলেন, গরু কেনা হয়ে গেছে। বড়সড় গরু। ভাল ছুরি না হলে পশুর কষ্ট বেশি হবে। তাই মজবুত ও ধারালো ছুরি কিনতে এখানে এসেছি। এখানে অনেক আছে। দেখে নেয়া যায়। এ কারণেই কাওরান বাজারে আসা বলে জানান তিনি।
আবদুল হামিদ মুর্শিদ নামের এক ক্রেতাকে পাওয়া গেল, যিনি আবার পেশায় শিক্ষক। একটি বেসরকারী কলেজে পড়ান। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কোরবানির ছুরি কেনার লোক আছে আমার। কিন্তু সে এখন করোনায় আক্রান্ত। তাই নিজে এসেছি। অভিজ্ঞতা মিশ্র। এখানে যেভাবে ধারালো সব অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেখে যে কারও পিলে চমকে যাবে।
আমার নিজেরও রীতিমতো ভয় লাগছে। তবে কামারশালায় যারা কাজ করছেন তাদের দেখে গ্রামের স্মৃতি মনে পড়ে গেছে বলে জানান তিনি। বলেন, কামারদের পেশা অনেক প্রাচীন। রাজধানীতে এখনও এই পেশা টিকে আছে দেখে ভাল লাগছে।
কোরবানির জন্য ছুরি কিনলেও, তিনি বলেন, মনের পশুকেই জবাই করতে হবে আগে। এটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী। কোরবানির ঈদ থেকে মহৎ হওয়ার এ শিক্ষা সবার নেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।