কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের অগ্রিম টিকেটের জন্য লাইন
ঈদ-উল-আজহার ছুটিতে ঢাকার বাইরে যেতে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। শুক্রবার টিকেট বিক্রির প্রথম দিনেই যাত্রীরা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট পেয়ে শেষ হাসি হেসেছেন। তবে কেউ কেউ বৃহস্পতিবার রাত থেকেই স্টেশনে অবস্থান করেও কাক্সিক্ষত এসি টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। আবার কোন কোন যাত্রী ১৭-১৮ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট না পাওয়ার হতাশার কথা বলেছেন। এবার রাজধানীর সাতটি স্থান থেকে ট্রেনের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। তবে মূলত উঞ্চরাঞ্চলগামী ট্রেনের টিকেটের চাহিদা বেশি ছিল। নারীরা টিকেট কাটতে এসে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ঈদের মতো এবারও জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে ট্রেনের টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টিকেট বিক্রির প্রথম দিন শুক্রবার দুপুর ১২টার মধ্যে কমলাপুর রেল স্টেশনে সব টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। এই দিনে বিক্রি হয়েছে ৫ জুলাইয়ের অগ্রিম টিকেট। আশিক হোসেন নামে একজন বলেন, টিকেট বিক্রি সকাল আটটায় শুরু হলেও টিকেটপ্রত্যাশীরা বৃহস্পতিবার থেকেই কমলাপুর স্টেশন ও শহরতলী স্টেশনের বিভিন্ন কাউন্টারের সামনে ভিড় করেন। অনেকে দীর্ঘ ১৮-১৯ ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে টিকেট কিনেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, তারা কাক্সিক্ষত টিকেট পাননি। তাই শুক্রবার দুপুর পর ফের ৬ জুলাইয়ের টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট পেতে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই স্টেশনে চলে এসেছিলেন বাসাবোর বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম। রাত ১১টায় অগ্রিম টিকেটপ্রত্যাশীদের সারিতে দাঁড়ান তিনি। তখন তার সামনে অপেক্ষমাণ শতাধিক মানুষ। অগ্রিম টিকেট পেতে সারা রাত সেখানে অপেক্ষা করেন তারা। শুক্রবার সকাল আটটায় অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরুর পরও লালমনিরহাটে যাওয়ার টিকেট পাননি রাশেদুল। আমিনুল বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় এসেছিলাম। সকাল ১০টার দিকে যখন টিকেট শেষ হয়ে যায়, তখন আমার সামনে তিনজন লোক ছিলেন। বাসাবোতে থাকা আমিনুল একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আগামী ৬ জুলাইয়ের টিকেট পেতে শুক্রবার ফের তিনি লাইনে দাঁড়ানোর সিরিয়াল দিয়ে রেখেছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার বিক্রি করা হয়েছে ৫ জুলাইয়ের ট্রেনের টিকেট, আজ শনিবার বিক্রি হবে ৬ জুলাইয়ের টিকেট, ৩ জুলাই বিক্রি হবে ৭ জুলাইয়ের টিকেট, ৪ জুলাই বিক্রি হবে ৮ জুলাইয়ের টিকেট এবং ৫ জুলাই বিক্রি হবে ৯ জুলাইয়ের ট্রেনের টিকেট। এছাড়া ফিরতি টিকেট বিক্রি শুরু হবে ৭ জুলাই থেকে। ওই দিন ১১ জুলাইয়ের টিকেট বিক্রি হবে। ৮ জুলাই ১২ জুলাইয়ের টিকেট, ৯ জুলাই দেয়া হবে ১৩ জুলাইয়ের টিকেট, ১১ জুলাই ১৪ এবং ১৫ জুলাইয়ের টিকেট বিক্রি হবে। ১০ জুলাই ঈদ হওয়ায় ১১ জুলাই সীমিত কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করবে। তবে ১২ জুলাই থেকে সব ট্রেন চলাচল করবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে প্রতিদিনের জন্য ২৬ হাজার ৭১৩টি আসনের টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। এসব টিকেটের ৫০ শতাংশ রেলস্টেশনের কাউন্টারে এবং ৫০ শতাংশ অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২টি কাউন্টার নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আলাদা রয়েছে। এবার মোট সাতটি স্টেশন থেকে ট্রেনের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। কমলাপুর রেলওয়ের মূল স্টেশন থেকে পুরো উত্তরাঞ্চলগামী আন্তঃনগর ও বীর মু. সি. ই (পঞ্চগড়) ঈদ স্পেশাল ট্রেনের, কমলাপুরের শহরতলী প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজশাহী ও খুলনাগামী সব আন্তঃনগর ট্রেনের, ঢাকা বিমানবন্দরে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী সব আন্তঃনগর ট্রেনের, তেজগাঁওয়ে ময়মনসিংহ, জামালপুর, দেওয়ানগঞ্জগামী সব আন্তঃনগর ট্রেন ও দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল ট্রেনের, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ ও হাওড় এক্সপ্রেস ট্রেনের, ফুলবাড়িয়ায় (পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন) সিলেট ও কিশোরগঞ্জগামী সব আন্তঃনগর ট্রেনের এবং জয়দেবপুরে বীর মু. সি. ই (পঞ্চগড়) ঈদ স্পেশাল ট্রেনের টিকেট বিক্রি হচ্ছে।
যাত্রীদের কাক্সিক্ষত টিকেট না পাওয়ার ব্যাপারে কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, টিকেট সীমিত। কাউন্টার থেকে আমরা শুক্রবার টিকেট দেয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৭০০-এর মতো। এই টিকেট দেয়া হবে সাতটি কেন্দ্র থেকে অর্থাৎ শুধু কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে এই টিকেট দেয়া হয়নি। কমলাপুর থেকে শুধু উত্তরবঙ্গের সাতটি ট্রেনের টিকেট দেয়া হয়েছে। টিকেটের তুলনায় প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবাইকে টিকেট দেয়া সম্ভব হয়নি। রেল কর্তৃপক্ষ টিকেট কালোবাজারি রোধে সচেষ্ট রয়েছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, এবার বাংলাদেশ রেলওয়ের স্লোগান টিকেট যার ভ্রমণ তার। গত রোজার ঈদে আপনারা দেখেছেন, আমরা এটা করেছি। টিকেটে ভ্রমণ নীতি নিশ্চিত হলে অবশ্যই কালোবাজারি রোধ সম্ভব হবে।
অনলাইনে অনেকে সার্ভারে প্রবেশ করতে না পারার এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, সহজ থেকে আমরা যে ব্যাখ্যাটা পেয়েছি তা হলোÑ সকালে ১৩ হাজার টিকেটের জন্য সাড়ে চার লাখ টিকেটপ্রত্যাশী সার্ভারে প্রবেশ করেছে। ১৩ হাজার মানুষই কিন্তু টিকেট পাবে, বাকিরা টিকেট পাবে না। অধিকাংশ লোকই যেহেতু টিকেট পাবে না অভিযোগটা তাদেরই থাকবে। আমি নিজেও সকালে চেষ্টা করে দেখেছি টিকেট কাটতে পারিনি। একসঙ্গে এত লোক টিকেট চাইলে তো আর পাওয়া সম্ভব হয় না। কাউন্টারে টিকেট কালোবাজারির সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, কাউন্টারে টিকেট কালোবাজারির সুযোগ নেই। রেলপথ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য এজেন্সি কাউন্টারের ভেতরে তদারকি করছে। আমাদের ১০ জন অফিসার রয়েছে কাউন্টারের ভেতরে।
অনলাইনে টিকেট বিক্রির মাধ্যমে রেলসেবা এ্যাপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, ঈদ-উল-ফিতরের মতো এবারও আমরা ৫০ ভাগ টিকেট এ্যাপের মাধ্যমে বিক্রি করছি। দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই পুরো টিকেট বিক্রি শেষ। তিনি আরও জানান, এবার এ্যাপের মাধ্যমে টিকেট বিক্রিতে কোন ধরনের ঝামেলা হয়নি। তিনি বলেছেন, অনলাইনে টিকেট পেতে প্রথম সেকেন্ডেই ৫ লাখের বেশি মানুষ হিট করেছেন। যার কারণে সার্ভার কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়। তবে তাদের টিকেট পেতে কোন সমস্যা হয়নি।
অতিরিক্ত ভিড় নেই বিমানবন্দর স্টেশনে ॥ ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী সব আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। সেখানে কমলাপুর স্টেশনের মতো ভিড় ছিল না। টিকেট বিক্রির প্রথম দিনে সেখানে নিয়মিত সময়ের চেয়ে একটু বেশি ভিড় ছিল। তা কোনভাবেই উপচে পড়েনি। শুক্রবারে যাত্রীরা আরামে বুথ থেকে টিকেট কিনতে পারছেন। চট্টগ্রামের আগাম টিকেট কিনতে আসা মোবারক হোসেন নামে এক যাত্রী বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে যথাসময়ে টিকেট কেটেছি। কোন ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। এনআইডি দিয়ে টিকেট কাটার সিস্টেম রাখায় অনিয়ম হচ্ছে না। নোয়াখালীর আগাম টিকেট নিতে আসা অপর যাত্রী বলেন, অন্যান্যবারের মতো এবার কোন ভোগান্তি নেই। এনআইডি কার্ডের সিস্টেম থাকায় ভোগান্তি কম পোহাতে হচ্ছে।
টিকেট পেতে নারীদের ভোগান্তির অভিযোগ ॥ ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের টিকেট বিক্রির প্রথম দিনে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন নারীরা বলে অভিযোগ উঠেছে। কমলাপুরে পুরো উত্তরাঞ্চলগামী আন্তঃনগর ও বী. মু. সি. ই (পঞ্চগড়) ঈদ স্পেশাল ট্রেনের টিকেট দেয়া হচ্ছে। এখানে ৯ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত মোট ১০টি কাউন্টারে টিকেট বিক্রি হচ্ছে। তার মধ্যে মাত্র একটি কাউন্টার থেকে দেয়া হচ্ছে নারীদের টিকেট। নারীদের ১৮ নম্বর থেকে টিকেট দেয়া হলেও ১৯ ও ২০ নম্বর কাউন্টার বন্ধ ছিল। নারীরা বলছেন, ১৯ ও ২০ নম্বর কাউন্টার থেকেও তাদের টিকেট দেয়া হলে তারা ভোগান্তিতে পড়তেন না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কমলাপুর রেলস্টেশনে পুরুষদের জন্য নয়টি কাউন্টার থাকলেও নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি। কাউন্টার একটি হলেও নারীদের সংখ্যা বেশি থাকায় লাইন ছিল পাঁচটি। কিন্তু একদম কাউন্টারের সামনে সেসব লাইন অনেকটাই একাকার হয়ে যেতে দেখা যায়। তাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এবং পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা না থাকায় কয়েক নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকে হাতপাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করেন। তারা ফ্লোরে বসে পড়েন। টিকেট কাটতে আসা রিনা বেগম বলেন, শুধু একটা কাউন্টার থেকে নারীদের টিকেট দেয়া হচ্ছে। দুটি কাউন্টারে টিকেট দিলে ভিড় কম হতো, ভোগান্তিও কম হতো। নারীদের কাউন্টারে টিকেট বিক্রি ছিল অনেকটাই ধীরগতির। নওগাঁর শান্তাহারে যাওয়ার জন্য টিকেট কাটতে আসা সাজেদা বেগম বলেন, সকাল সাতটায় এসেছি। তিন ঘণ্টায় তিন হাতও এগোতে পারিনি।
চট্টগ্রামে ট্রেনের টিকেট অগ্রিম বিক্রি শুরু ॥ স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, পবিত্র ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ১০টি আন্তঃনগর ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হলেও প্রথমদিন শুক্রবার তেমন ভিড় ছিল না। তবে অন্যান্য বারের মতো অনলাইনে টিকেট পেতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। শুক্রবার দেয়া হয়েছে ৫ জুলাইয়ের অগ্রিম টিকেট। তাই টিকেট বিক্রি ছিল কম। সরাসরি কাউন্টারে এসেই বেশিরভাগ যাত্রী টিকেট নিয়েছেন ভিড় ছাড়াই। রেলওয়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রবিবার থেকেই মূলত ভিড় বাড়বে।
সকাল ৮টা থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে টিকেট দেয়া শুরু হয়। অগ্রিম টিকেট বিক্রির কার্যক্রম দেখতে স্টেশন পরিদর্শনে আসেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা। তবে অনলাইনে টিকেট না পেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বেশিরভাগ যাত্রী। অনলাইনে সার্ভার ডাউন ও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টিকেট পাননি কেউ। তাই বাধ্য হয়ে স্টেশনের কাউন্টারে এসে টিকেট নিয়েছেন যাত্রীরা।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক রতন কুমার চৌধুরী জানান, টিকেট নিতে প্রথমদিন ভিড় থাকে না। অনলাইনে কিছুটা ভোগান্তি রয়েছে, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী নয়। আর রবিবার থেকে ভিড় বাড়বে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, শনিবার অগ্রিম টিকেট দেয়া হবে ৬ জুলাইয়ের। রবিবার ৭ জুলাইয়ের, সোমবার দেয়া হবে ৮ জুলাইয়ের যাত্রার টিকেট এবং মঙ্গলবার দেয়া হবে ঈদের আগেরদিন অর্থাৎ ৯ জুলাইয়ের টিকেট।