
সমুদ্র হক ॥ ধবধবে সাদার উপমায় বলা হয়- বকের পালকের মতো সাদা। সুন্দর পালকের এই বকের বাস নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে। বাংলার ঐতিহ্যের সংস্কৃতির পাখি বক। নিজ ভুবনের আপন পাখি বকের এখন ক্রান্তিকাল। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ধরলা নদীর পাড়ের বককে নিয়ে সেই করুণ গান ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...’ মতোই অবস্থা আমাদের দেশী পাখি বকের। খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই মানুষের খাবার টেবিলে যাচ্ছে।
নিরীহ এই বক পাখির কাছে মানুষের শেখার আছে অনেক। বককুলের যে কোন প্রজাতির বিপদে উড়ে এসে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে চতুর মানুষ। ঝাউগাছের মতো এক ধরনের ফাঁদ বানিয়ে তার ওপর একটি বন্দী বক রেখে দেয়। উড়ে আসা বক বন্দী বককে উদ্ধার করতে এসে নিজেই বন্দী হয়। বহু যুগ আগে আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হলে নদী বিল জলাশয়ে থাকা আমাদের বক অতিথি পাখিদের বরণ করে নিয়ে থাকবার জায়গা করে দেয়।
নিকট অতীতে নদী বিলে ঝিলে বকদের সারি মন ভরিয়ে দিত। কখনও গাছের ওপরে উড়াউড়ি করে কখনও শাখায় বসে ক্লান্তি কাটিয়ে ফের উড়াল দিত। চরে কানি বক, গো বক, মঝলা বগা, ধুপানি বকদের দেখা যায়। চলনবিল, হাকালুকির হাওড়, মনপুরার চর, পাতারচর, সোনাদিয়ার চর এবং বড় নদ নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা নদীর পাড়ে বক পাখিদের ছিল নিরাপদ অভয়ারণ্য। প্রকৃতির নিসর্গের এই দৃশ্য এখন চোখে পড়ে কালেভদ্রে। শীত বসন্তে বক পাখিরা কখনও দল বেঁধে উড়ে কখনও মাছ শিকারে ব্যস্ত থেকে নদী ও বিলকে সৌন্দর্যে ভরে দিত।
দিশেহারা হয়ে বককুল আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। জায়গা পাচ্ছে না। বৃষ্টি ঝরলে বকেরা আশ্রয় নেয় গাছের শাখায়। খুঁজে বেড়ায় কাশবন, বাঁশ বাগান। বড় বৃক্ষ। এখন কাশ বনের কাঠি ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থালি উপকরণ বানানোর কাজে। বাঁশ বাগান কেটে সাফ। নগরায়নের অসামঞ্জস্য থাবায় গাছেরাও উধাও হয়ে যাচ্ছে। বৈশি^ক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারায় মনুষ্যকুলের সঙ্গে বককুলেরও ত্রাহী মধুসূদন অবস্থা। বকেরা এখন যায় কোথায়।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন নেচার (আইইউসিএন) সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ১১ প্রজাতির বকের মধ্যে সাত প্রজাতি দেশী। এর মধ্যে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি চারটি। এগুলো বাঘা বক, রঙ্গিলা বক, নিশী বক ও কোদালি বক। অতীতে এই বকগুলো মানুষের বাসের মধ্যেই উড়ে বেড়াত। নদী ও বিলের তীরে যাদের বাড়ি তারা রাতে নিশী বকের ওয়াক ওয়াক ডাক শুনত। নিশী বক এমন ডাকে মাছ খুঁজে বেড়ায়। নিশী বক রেহাই পাচ্ছে না। বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের পরিবেশবাদী সংগঠন টিম ফর এনার্জি এনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড রিসার্চের (তীর) সদস্যরা মাঝে মধ্যেই নদী বিল চর এলাকা থেকে নিশী বক উদ্ধার করে কোন জলাশয়ে অবমুক্ত করে।
আইইউসিএন জানায়, আর্ডেইডি গোত্রের মিঠা পানির মৎস্যভোজী জলচর প্রাণী বক। পৃথিবীতে বক পাখির প্রজাতি অন্তত ৬৪। এর মধ্যে বড় আকৃতির কিছু বক ভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। কিছু কোম্পানি তাদের প্রোডাক্টে কিং স্টর্কের (বড় বক) ছবি দিয়ে বিপণন করছে। যা বাংলাদেশে ‘বগা’ নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশে বকের কিছু প্রজাতি বগলা ও বগা নামে পরিচিতি পেয়েছে। এই বকের শরীরে সাদার প্রাধ্যান্য বেশি।
দেশে কানি বক সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই বককে নিয়ে ছড়া ‘ওই দেখা যায় তাল গাছ ওই আমাদের গাঁ, ওইখানেতে বাস করে কানি বকের ছা...’ প্রবীণরা ছোট বেলায় পড়েছে। শিশুরা আজও খুব মজা করে পড়ে। ছেলেবেলায় দাদি নানিরা মজা করে বলতেন কানি বক কানা বক। আসলে ঠিক উল্টো। কানি বকের চোখ সবচেয়ে উজ্জ্বল। সকল জাতের বকের বৈশিষ্ট্য প্রায় এক। সাদা ধবধবে বকের পাশাপাশি গলায় ছাই রঙের, কিছুটা ধূসর বর্ণের বক আছে। তীক্ষè ঠোঁট, লম্বা গলা, লম্বা পা, মাথায় ঝুলে থাকা সোনালি ঝুঁটি এমন ধরন সকল বকের মধ্যেই আছে। বককে নিয়ে নানা কথা আছে। বক বধ করে নরম পালকে নাড়া চাড়া করলে সুযোগ বুঝে বক চোখে ঠোকর দেয়। এর বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ হলো : বকের চোখের জ্যোতি বেশি। নদী বিলের জলের গভীরে ও ডাঙ্গায় দূরের জিনিস দেখতে পায়। কোন কিছু হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার পর বকের চোখের উপমা দেয়া হয়।
বক বিপন্ন হওয়ার কারণ ॥ জলাভূমি ব্যবহারে অসচেতনতা। রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাত্রা বেশি। দেশী বৃক্ষরোপণ কম ও বট পাকুরের গাছ কেটে ফেলা। বকের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া। এভাবে গত দশ বছরে উত্তরাঞ্চলের নদ নদী, খাল বিল, পূর্বাঞ্চলের হাওড়, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এলাকা এবং সুন্দরবনে বকের সংখ্যা কমেছে। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বহু প্রজাতির বকের বিচরণ ক্ষেত্র। বাংলাদেশে বকের আগমন ঠিক কবে হিসাব নেই। তবে মনে করা হয় ছয় ঋতুর বৈচিত্র্যের এই দেশে বক পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে শুরু করেছে লাখো বছর আগে। সেই হিসাবে বক বাংলাদেশের আপন ভুবনের পাখি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় বাংলাদেশ থেকে বক পাখির প্যেটেন্ট কেড়ে নেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। বকেরা কি এখন নিজভুমে পরবাসী হয়ে থাকবে! শিকারির ভয়ে চেনা পথ ছেড়ে উড়াল দিয়ে খুঁজে ফিরবে নিরাপদ কোন অভয়ারণ্য।