ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

ঠান্ডার দেশের ফুল টিউলিপ, চাষ হচ্ছে তেঁতুলিয়ায়

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ৩১ জানুয়ারি ২০২২

ঠান্ডার দেশের ফুল টিউলিপ, চাষ হচ্ছে তেঁতুলিয়ায়

এ রহমান মুকুল ॥ চা কমলা, মাল্টার পর এবার ঠান্ডার দেশের টিউলিপ এখন তেঁতুলিয়ায় চাষ হচ্ছে। বিদেশে রফতানিযোগ্য টিউলিপের বাণিজ্য সফল চাষ বদলে দিয়েছে দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের দৃশ্যপট। বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কা-) রোপণের মাত্র ২৩ দিনের মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমান্তঘেঁষা সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আট কিষানির বাগানে ফুটেছে রাজসিক সৌন্দর্যের ফুল টিউলিপ। গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের কেওয়া দক্ষিণখান গ্রামের দেলোয়ার দম্পত্তির প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে প্রথম টিউলিপ ফুল চাষ হয়। এবার দেশে দ্বিতীয়বার তেঁতুলিয়ার আট কিষানি সফলভাবে এ ফুল ফুটিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ ছাউনির নিচে সারি সারি টিউলিপ ফুটেছে। তাদের এই সফলতায় দেশে টিউলিপ ফুল চাষের আশা জাগছে। বিশেষ করে শীতপ্রবণ এ জেলাটিতে টিউলিপ ফুল চাষে বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ। ভারত সীমান্তঘেঁষা সারিয়ালজোত-দর্জিপাড়ার টিউলিপ ফুল বাগানগুলো হয়ে উঠেছে একটি দর্শনীয় স্থান। এই গ্রাম দুটির নাম বদলে হয়েছে টিউলিপ গ্রাম। প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়ার পর বিদেশী এই ফুলের বাগান দেখতে এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য মানুষ। যারা আসছেন তারা সবাই টিকেট কেটে বাগানে প্রবেশ করছেন। ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিওকলে পরিবারসহ বন্ধুদের দেখাচ্ছেন টিউলিপের সৌন্দর্য্য আবার অনেকে ফোটানো টিউলিপ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ইফটিউবাররাও এ থেকে নেই পিছিয়ে। বাগানে ফোটা ফুলের চাহিদা আর কদর দেখে টিউলিপ চাষের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন অনেকেই। শনিবার তেঁতুলিয়ার সারিয়ালজোত-দর্জিপাড়া গ্রামের টিউলিপ বাগানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, শত শত টিউলিপ সারি সারি ফুটে রয়েছে। কয়েক দিন ধরেই একের পর এক ফুটতে শুরু করেছে এই ফুল। ৬ প্রজাতির ১২টি রঙের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফুটেছে বেগুনি, হলুদ, লাল, সাদা, কমলা এই পাঁচ ধরনের ফুল । এই ফুল ফোটাতে উচ্চ কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ফুলগুলো একটি শেডের নিচে চাষ হচ্ছে। শেড একটি বিশেষ ধরনের পলিথিন দিয়ে ঢাকা। আর চারপাশ ঢাকা ছোট ছিদ্রযুক্ত নেট দিয়ে। পুরো শেডটিতে বিশেষ পদ্ধতিতে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করা হয় সূর্যের আলো। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও রাতে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে পূর্ণ বয়সের আগে মানসম্মত ফুল নাও ফুটতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোপণের ১৮ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কলি আসতে শুরু করে এবং ২৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত ফুল স্থায়ী হয়। অনেক সময় আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ব্যতিক্রমও হতে পারে। হিমালয় কন্যাখ্যাত শীতপ্রবণ জেলা পঞ্চগড়। এ জেলায় বছরের প্রায় চার মাস শীতের আবহাওয়া থাকে। এই আবহাওয়াকে কাজে লাগাতে তেঁতুলিয়ায় প্রথমবারে ক্ষুদ্র চাষীদের মাধ্যমে খামার পর্যায়ে টিউলিপ ফুল চাষের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপ উৎপাদনের এ উদ্যোগ নেয় বেসরকারী সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শীতপ্রধান এলাকা হিসেবে তেঁতুলিয়া উপজেলাকে নির্বাচন করা হয়। এ বছরের ১ জানুয়ারি উপজেলার সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আয়েশা বেগম, সাজেদা বেগম, মুক্তা বেগম, আনোয়ারা বেগম, সুমি আক্তার, হোসনেআরা বেগম, মনোয়ারা ও মোর্শেদার ৪০ শতক জমিতে নেদারল্যান্ডস থেকে আনা ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কান্ড) রোপণ করা হয়। ফুলচাষী সাজেদা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, ঠান্ডার দেশের এই ফুল আমাদের তেঁতুলিয়াতেও হচ্ছে। কারণ এখানেও বেশির ভাগ সময় ঠান্ডা অনুভূত হয়, এ জন্য ভালো টিউলিপ ফুল ফুটেছে। ইএসডিও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ঢাকার ফুল ব্যবসায়ীরা এসে বাগান থেকে ফুল নিয়ে যাচ্ছেন। দামও ভাল পাচ্ছি। আগামীতে আরও বেশি জায়গাজুড়ে এ ফুলের চাষ করব। আরেক ফুলচাষী আয়েশা আক্তার জনকণ্ঠকে জানান, জমিতে বাল্বগুলো রোপণ করার ২২ দিনের মধ্যেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই এখানে অনেক দর্শনার্থী আসছেন। তারা টিউলিপ বাগানে এসে ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। অনেকে প্রতিপিস ১০০ টাকা দরে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ইএসডিওর টিউলিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী মোঃ আইনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে প্রায় ৬২ টাকা খরচ হয়েছে। পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সফল হলে পরবর্তী সময়ে বৃহৎ আকারে প্রকল্প হাতে নিয়ে কমপক্ষে এক হাজার চাষীকে দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ ফুলের চাষ সম্প্রসারণ করা হবে। তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ইএসডিওর এই টিউলিপ প্রকল্পের এই টিউলিপ চাষ কৃষি বাণিজ্যে ও পর্যটনের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলে দিবে। টিউলিপের চাষ নিয়ে ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. শহীদ উজ জামান জনকণ্ঠকে শোনান তার স্বপ্নের কথা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম টিউলিপের চাষ হয় গাজীপুরের শ্রীপুরে। দেলোয়ার দম্পত্তি প্রথমবারেই বাণিজ্যসফল টিউলিপ ফুলের চাষ করেন। সফল টিউলিপ চাষী দেলোয়ার হোসেনের সহযোগিতায় নেদারল্যান্ডস থেকে ৪০ হাজার টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কান্ড) নিয়ে এসে সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়ার ৮ কিষানির কাছে বিতরণ করা হয়। তারা ৪০ শতক জমিতে রোপণ করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন। নিয়মিত পরিচর্যা আর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথমবারেই পেয়ে যান সফলতা। তিনি বলেন, ভিন্ন সৌন্দর্য্যরে টিউলিপ ফুলের পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই, বাংলাদেশের ফুলের বাজারে গোলাপসহ অন্য ফুলের ভিড়ে ব্যাপকভাবে টিউলিপ ছড়িয়ে দিতে চাই। তিনি বিশ্বাস করেন, গোটা পঞ্চগড় জেলাতেই টিউলিপ ফুল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আগামীতে বড় পরিসরে উৎপাদনে যাওয়ার কথা চিন্তা করছি। তিনি আরও বলেন, টিউলিপ ফুলের বীজ বাইরের দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয় যার কারণে খরচ বেশি হয়। তেঁতুলিয়ায় বীজ উৎপাদন করে সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা গেলে চাষীরা স্বল্পমূল্যে এ ফুল উৎপাদন করতে পারবেন। আমাদের সেই চিন্তা ভাবনাও রয়েছে। বৈশিষ্ট্য ॥ টিউলিপ ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম টুলিপা। পাত্রে চাষাবাদের উপযোগী এক প্রকার পুষ্পজাতীয় উদ্ভিদ। এটি বাণিজ্যিকভিত্তিতে জমিতেও চাষ করা হয়। ভারতের জম্মু কাশ্মীরে টিউলিপের প্রসিদ্ধ বাগান রয়েছে যা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পুরো বিশ্বে বিখ্যাত। এর অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়। বর্ষজীবী ও কন্দযুক্ত প্রজাতির এ গাছটি লিলিয়াসিয়ে পরিবারভুক্ত উদ্ভিদ। শঙ্করায়ণসহ টিউলিপের সকল প্রজাতিকেই টিউলিপ নামে ডাকা হয়। টিউলিপ প্রায় ১৫০ প্রজাতিতে বিভাজ্য এবং অগণিত শঙ্কর প্রজাতি রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রকার ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ। এটি বাগানে কিংবা কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হয়। টিউলিপ মূলত বর্ষজীবী ও শীতপ্রধান দেশের বসন্তকালীন ফুল হিসেবে পরিচিত। চাষাবাদ ॥ বাণিজ্যিকভিত্তিতে অটোম্যান সাম্রাজ্যে চাষাবাদ শুরু হলেও পরবর্তীকালে নেদারল্যান্ডসে বাণিজ্যধর্মী আবাদ শুরু হয়। হল্যান্ড বিশ্বের প্রধান টিউলিপ উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে পরিচিত। বার্ষিক তিন বিলিয়নেরও অধিক টিউলিপ কন্দ উৎপাদন করে ও রফতানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসরূপে বিবেচিত। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে টিউলিপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। চাষাবাদ প্রণালীকে প্রায়শই ‘ডাচ টিউলিপ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। দুটি প্রধান কারণে টিউলিপ উৎপাদন করা হয় যেমন, ফুল উৎপাদন এবং শুষ্ক কন্দ উৎপাদন। উদ্যান, বাগান, গৃহে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কন্দ উৎপাদন করা হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ফুলের বিনিময়ে মূল্য প্রায় এগারো হাজার মিলিয়ন ইউরোতে দাঁড়িয়েছে যা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সচল করে রাখছে।
×