
মোরসালিন মিজান ॥ হিজল নামটাই ভারি সুন্দর। কী যেন আছে এই নামে। খুব আকর্ষণ করে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে এই গাছ এই ফুলও ভীষণ প্রিয়। শহরে বসে আমরা গ্রামের কত ছবিই না কল্পনা করি। সেসব ছবির কোন না কোন একটিতে ঠিক এসে ধার দেয় হিজল। গাঁয়ের গন্ধমাখা হিজল শহরে একেবারেই নেই এমন নয়। কম বেশি আছে। এমনকি আছে রাজধানী শহরেও। ঢাকার প্রধান প্রধান উদ্যান ও পার্কে বহুকাল ধরে গাছটি দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায় সামান্য। তবে গ্রামের নদী জল প্রকৃতি পরিবেশের কথা এটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়তই। হিজলের দীর্ঘ ঝুলন্ত মঞ্জরি রঙিন ফুল শহুরে প্রলোভনের বিপরীতে গ্রামে ফেরার আন্তরিক আহ্বান জানায়। শুনতে পাচ্ছেন সে আহ্বান? সময়টা কিন্তু এখনই। এই বর্ষায় হিজল তার আশ্চর্য রূপ আর সতেজতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
হিজলের লাল ও গোলাপি রঙের ফুল হয়। গভীর রাতে ফোটে। সকালে ঝরে যায়। ফুলের ঘ্রাণটাও বেশ মিষ্টি। বাতাসে দুলতে থাকা ফুলে মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। তারও বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন শিল্পী সাহিত্যিক ও কবিরা। বহু পুরনো রচনায় হিজলের উল্লেখ পাওয়া যায়। মৈমনসিংহ গীতিকার এক জায়গায় হিজল এসেছে এভাবে- পাষাণে বান্ধিয়া হিয়া বসিল শিওরে।/নিদ্রা যায় নদীয়ার ঠাকুর হিজল গাছের তলে...। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন : প্রাণে তার ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;/একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো...। আর হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার বেদনাবোধের কথা জানাতে বিখ্যাত একটি গানে রচনা করেছিলেন। মহান গীতিকার সুরকার লিখেছেন : হাওড়ের পানি নাইরে হেথায়/নাইরে তাজা মাছ/বিলের বুকে/ডানা মেইলা/নাইরে হিজল গাছ...। সত্যি নাই হয়ে যাচ্ছে হিজল গাছ।
গ্রামে হিজল বেশি হয়, বলেছিলাম। এর কারণ গাছটি জলাবদ্ধ পরিবেশে ভাল থাকে। আর বাংলাদেশের গ্রাম মানেই তো নদী হাওড় খাল বিল ঝিল। জলমগ্ন জলসংলগ্ন অঞ্চলে গাছটি প্রচুর পরিমাণে জন্মে। বিখ্যাত চলনবিলের কথাই যদি বলি, বিলের মাঝখান দিয়ে ট্রেন লাইন বয়ে গেছে। চলন্ত ট্রেন থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে হিজলের দীর্ঘ সারি। অগণিত গাছ দুই পাশে রেখে সাঁই সাঁই করে ছুটছে ট্রেন। কত গাছ যে পেছনে পড়ছে। আবারও সামনে দেখা যাচ্ছে সে একই গাছ। রঙিন ফুলের ঝুলন্ত মঞ্জরি দেখে অভিভ‚ত না হয়ে পারা যায় না। বর্ষায় পথটি দিয়ে যাওয়া আসার সময় যারা মনোযোগ দিয়ে এ দৃশ্য দেখছেন না তারা, নিশ্চিত বলতে পারি, বঞ্চিত।
একইভাবে হিজলের বড় আবাস হাওড় অঞ্চল। এখন লিখতে বসে ভাটিবাংলা সুনামগঞ্জের কথা আলাদা করে মনে পড়ছে। জেলার তাহিরপুরে একাধিক হাওড়। হাওড় মানে, বিপুল জলরাশি। ভরা বর্ষায় হাওড়ের বুকে ঢেউ তুলে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যায় ইঞ্জিনের নৌকা। নৌকা থেকে চারপাশে তাকালে থৈ থৈ জল দেখা যায়। আর দেখা যায় হিজল গাছ। হাওড়ের জল ছুঁয়ে থাকা গ্রামগুলোকে এই গাছ চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে। দেখে মনে হয় পরিকল্পিত সবুজ বাগান। বাড়ির পেছনের দিকে বড় হতে থাকা হিজলের ঝুলন্ত মঞ্জরি বর্ষার নয়া পানিকে যেন ডেকে আনে। স্পর্শ করতে চায়। ঘাটে নৌকা লাগতেই স্বাগত জানায় যে ফুল, সেটিও হিজলের। স্থানীয়দের খুব চেনা এবং উপকারী গাছটি শুকনো মৌসুমেও দিব্যি থাকে। হাওড়ের পানি সরে যাওয়ার পর নতুন চেহারা পায়। চাষযোগ্য জমির আইলের ওপর, পায়ে হাঁটা পথের ধারে দৃশ্যমান হয় হিজল গাছ।
রাজধানীতে হিজল দেখতে হলে উদ্যান বা পার্কেই যেতে হয়। পাশাপাশি কিছু সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এ গাছ লাগানো হয়েছে। এই যেমন শিল্পকলা একাডেমি একাডেমির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল। অনেকদিন আগের কথা। এখন ভরপুর প্রাণ। শুকনো, জ্বলতে থাকা, পুড়তে থাকা শহরে কী করে বেঁচে আছে প্রিয় হিজল? ভেবে অবাক হতে হয়। অবশ্য হিজলের প্রাণশক্তি অনেক বেশি। বিধ্বংসী বন্যা কিংবা তীব্র খরাও কুপোকাত করতে পারে না। বরং অন্যের যত্ন ছাড়াও বাঁচতে পারে। জল এবং স্থল দুই জায়গাতেই সাবলীল। একাডেমির হিজল গাছগুলোও তাই বেশ আছে। রাজধানীর প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। অন্য অনেক গাছের পাশে থেকেও বৈশিষ্ট্য হারায়নি। ম্লান হয়নি। বরং নিজের জাত চেনাতে সীমানা প্রাচীর টপকে বাইরে ফুটপাথের ওপর এসে আছড়ে পড়েছে লম্বা মঞ্জরি।
প্রসঙ্গ উঠতেই শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলছিলেন, এই চত্বরে হিজল গাছ দেখে অনেকেই অবাক হন। বহু লোকগানে, গীতিকায়, কবিতায় গাছটির কথা আছে। শিল্পীরা গান গাওয়ার সময়ও হিজলের নাম নেন। তবে তাদের বড় একটি অংশ এ গাছ চেনে না। একাডেমি প্রাঙ্গণে লাগানোর ফলে সবার চেনার সুযোগ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হিজলের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারত। সাধারণত পানি বা কাদাজলে জন্মাতে দেখা যায়। মাঝারি আকারের গাছ। ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত উপরে ওঠে। মাটির কাছাকাছি থেকে ডালপালা চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। হিজল একইসঙ্গে নিচুল, জলন্ত, নন্দীক্রান্ত নামে পরিচিত।
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে জানা যায়, হিজল দীর্ঘজীবী গাছ। এর ঝুলন্ত মঞ্জরি ৬-১৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। মঞ্জরির পুরোটাজুড়ে ক্ষুদ্র কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর ফুল হয়। বহুপৌষ্পিক ফুলের বৈশিষ্ট্যে হিজল অনন্য বলে মনে মত দিয়েছেন তিনি।