ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৭ মে ২০২৪, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর পলাতক তিন খুনীর কোন হদিস নেই

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১০ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধুর পলাতক তিন খুনীর কোন হদিস নেই

শংকর কুমার দে ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর বিদেশ পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে দুই খুনীর বিদেশে অবস্থান জানতে পারলেও অপর তিন খুনী কে কোথায় অবস্থান করছে তা জানে না সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থারত রাশেদ চৌধুরী ও কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর জন্য আইনী প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়েছে কূটনৈতিক উপায়ে। অপর তিন খুনী শরীফুল হক ডালিম, খন্দকার আবদুর রশীদ ও মোসলেম উদ্দিন বিদেশের কোন দেশে অবস্থান করছে তার হদিস করতে বিদেশে অবস্থারনত কূটনৈতিক মিশনগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এছাড়া তিন খুনীর অবস্থান খুঁজে বের করতে রেড নোটিস জারির পর তা নবায়ন করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। শোকের মাস আগস্টে, বিদেশে পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করতে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকার গঠিত টাস্কফোর্স। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে আব্দুল মোমেন শনিবার মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মধ্যে বিদেশে পলাতক ৩ খুনীর অনুসন্ধানে প্রবাসী সব বাংলাদেশীর সহযোগিতা চেয়েছেন। ড. মোমেন বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পাঁচ পলাতক খুনীর মধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যজন কানাডায় অবস্থান করছে। তাদের ফেরত আনার জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ৩ খুনীর অবস্থান আমরা এখনও জানি না। তাদের অনুসন্ধান করার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সব বৈদেশিক মিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, শোকের মাস আগস্টকে সামনে রেখে বিদেশে পলাতক পাঁচ খুনীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডায় অবস্থানরত রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিদেশে পলাতক তিন খুনীর অবস্থান জানার চেষ্টার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর রাষ্ট্রদূতদের। বিদেশে অবস্থারনত কূটনৈতিক মিশনের রাষ্ট্রদূতদের এই বিষয়ে তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থারনত এ এম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। আর কানাডায় মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলোপ হওয়ায় এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে ফেরানোটা আটকে আছে আইনী প্রক্রিয়ায়। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পালিয়ে থাকা ছয় আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনীর মধ্যে দুজনকে ফেরানোর ব্যাপারে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি আইনী পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে নূর চৌধুরীকে ফেরাতে আইনী লড়াই শুরু হয়েছে কানাডায়। তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর আগে ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বা প্রি-রিস্ক রিমুভাল এ্যাসেসমেন্টের (পিআরআরএ) বিষয়ে রায় পেতে গত বছরের জুলাইয়ে কানাডার সরকার কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা করেছে। সেপ্টেম্বরে নূর চৌধুরীর অবস্থানের বিষয়ে রায় বা মতামত দেবেন কানাডার আদালত। এছাড়া রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্কাডেন এল এলপি নামে একটি আইনী পরামর্শক সংস্থাকে নিয়োগ করেছে সরকার। রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর জন্য ইতোমধ্যেই আইনী প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারও। ঢাকা ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরানোর ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লেখা চিঠিতেও রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, কয়েক বছর আগে খন্দকার আবদুর রশীদ ও শরিফুল হক ডালিমকে কখনও স্পেন ও কখনও পাকিস্তান, আবদুল মাজেদকে সেনেগাল এবং মোসলেমউদ্দিনকে জার্মানিতে দেখা যাওয়ার বিষয়ে অসমর্থিত সূত্রে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। জার্মানি, স্পেন ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মিশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেমউদ্দিন ওই তিন দেশে অবস্থান করছেন না। এদিকে লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বলেছেন, ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের আগ পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই লিবিয়ায় অবস্থান করতেন খন্দকার আবদুর রশীদ। উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ওই খুনী গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য ব্যবসা করতেন। জাতীয় সংসদে প্রশ্নত্তোরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, জাতির পিতার হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ৫ জনের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অপর আসামি মেজর (অব) আবদুল আজিজ পাশা জিম্বাবুইয়েতে মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানা যায়। অবশিষ্ট পলাতক ৬ আসামি আনুমানিক অবস্থান অনুযায়ী লে. কর্নেল (অব) খন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তান/লিবিয়া, মেজর (অব) শরিফুল ইসলাম ডালিম পাকিস্তান/লিবিয়া কিংবা জিম্বাবুইয়ে, মেজর (অব) আবু মোহাম্মদ রাশেদ চৌধুরী আমেরিকা, মেজর (অব) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী কানাডা, ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদ ডাকার (সেনেগাল) এবং রিসালদার (অব) মোসলেহ উদ্দিন ভারতে পালিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে আবদুল মাজেদ ভারত থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পর চলতি বছর ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রেফতারের পর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অপর আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার পর ঢাকার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে- এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ভারতের একাধিক সংবাদ মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মোসলেম উদ্দিনের গ্রেফতারের বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করা হয়নি। প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপীল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপীল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেয়া ১২ খুনীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়রি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় রায় কার্যকরের আগেই ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুইয়েতে মারা যান আজিজ পাশা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকচক্র শাহবাগে বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র দখল করে। ভোর পৌনে ছয়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা ফাঁকা গুলি করতে করতে বেতার ভবনে ঢোকে। নিয়ন্ত্রণ নেয় বেতারকেন্দ্রের। খুনী মেজর ডালিম ভোর ৬টা ১০ মিনিটে প্রথম ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা। কিছুক্ষণ পরপর এই ঘোষণা প্রচার হতে থাকে। বেতারে ঘোষণা প্রদানকারী শরিফুল হক ডালিম, হত্যাকারীদের অন্যতম হোতা খন্দকার আবদুর রশীদ ও মোসলেম উদ্দিন কোন দেশে আত্মগোপনে আছেন এখনও তা অজানা।
×